
আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। শুরু থেকেই এটিকে তার পরিবার ও সহপাঠীরা হত্যা বলে সন্দেহ করছে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাপ্রবাহ দেখেও সেটিই মনে হয়েছিল।
কিন্তু গত ১৪ ডিসেম্ববর ডিবি পুলিশ ও র্যাব যখন আলাদা সংবাদ সম্মেলনে দাবি করল যে, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন, তখন অনেকের মনেই এই প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে যে, ফারদিনের ঘটনাটিও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির কেস হলো কি না? কারণ ময়নাদতদন্তের পর চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, ফারদিনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
শুধু তাই নয়, ফারদিনের মৃতদেহ উদ্ধারের চারদিনের মাথায় ১১ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মো. শাহীন নামের (সিটি শাহীন নামে পরিচিত) এক ব্যক্তি নিহত হন, যে চনপাড়া বস্তিতে ফারদিন গিয়েছিলেন বা তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলেও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। সুতরাং বন্দুকযুদ্ধে শাহীনের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে ফারদিনের মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না, সে প্রশ্নেরও সুরাহা হয়নি।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ঘটনার রাতে ফারদিনের একটি সিমের নেটওয়ার্ক চনপাড়ার একটি টাওয়ার ও আরেকটি ব্রিজের পাশের একটি টাওয়ার কভার করেছে। তার সর্বশেষ লোকেশন সুলতানা কামাল ব্রিজে ছিল। কিন্তু সেখানে সিসি ক্যামেরা এবং প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় কিছুই জানা যায়নি। (মানবজমিন, ২৮ নভেম্বর ২০২২)।
অবশ্য পরে পুলিশ জানিয়েছে যে ফারদিন চনপাড়া বস্তিতে যাননি। কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছে, এ ধরনের তথ্যও পাওয়া যায়নি। যদিও ১৩ নভেম্বর ফারদিন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চনপাড়া বস্তির ৪ মাদক চোরাকারবারি রায়হান মাহমুদ, উজ্জল, রনি ও নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু বলেনি।
তাহলে কি শাহীনের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া কিংবা কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর গ্রেপ্তার/ অংকের সঙ্গে ফারদিনের মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র নেই? অথচ র্যাব এর আগে বলেছিল, রায়হান মাহমুদ ও তার গ্যাং মিলেই ফারদিনকে চনপাড়া বস্তিতে হত্যা করেছে বলে সন্দেহ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে। (ডেইলি স্টার, ৫ ডিসেম্বর ২০২২)। প্রশ্ন হলো, সেই তথ্যপ্রমাণ কোথায় গেল? এখন কেন এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলা হচ্ছে?
প্রসঙ্গত, নিখোঁজের তিন দিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বনানী ঘাট সংলগ্ন লক্ষ্নীনারায়ণ কটন মিলের পেছন থেকে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই রহস্যের বৃত্তেই ঘুরপাক খায় এই মৃত্যুর ঘটনাটি। গণমাধ্যমে নানারকম তথ্য প্রকাশিত হয়, যার অধিকাংশেরই সূত্র আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী। কিন্তু কেউই কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারছে না। বরং নানারকম বিভ্রান্তি প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় নির্মমভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার এবং তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি। কিন্তু গত ১০ বছরেও এই হত্যার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী। এরই মধ্যে এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে ৯৪ বার সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তার মানে আর মাত্র ৫ বার সময় নিলেই এটি শততমর মাইলফলক স্পর্শ করবে। পৃথিবীর কোনো হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এরকম ঘটনা এই প্রথম ঘটবে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ভাগ্যিস, এখনো এটা বলা হয়নি যে সাগর-রুনি আত্মহত্যা করেছেন!
প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশের একজন এসআই। চার দিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাবের কাছে। তারাও এই ঘটনার কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। প্রশ্ন হলো- কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে যে, পুলিশ-ডিবি-র্যাব সবাই ব্যর্থ হচ্ছে এই ঘটনার জট খুলতে?
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের মৃত্যু ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলনে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, ফারদিন নূর পরশ অন্তর্মুখী ছিলেন। সবার সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে পারতেন না। নানা কারণে মানসিক চাপে ছিলেন। তিনি যেভাবে উন্মত্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাতে প্রতীয়মান হয়, মানসিকভাবে ডিস্টার্ব ছিলেন। কারও সঙ্গে ওই দিন রাতে দেখা করেননি।
তিনি বাবুবাজার ব্রিজ টার্গেট করেন। রাত ১০টা ৫৩ মিনিট থেকে ১১টা ৯ মিনিট, এই সময় বাবুবাজার ব্রিজ অনেক ব্যস্ত থাকায় সম্ভবত তিনি ওখান থেকে পিছপা হন। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে সময় নেন। এরপর আবার নিজের বাসা অতিক্রম করে ডেমরা সেতুতে যান। সর্বশেষ তার গ্রামীণ নম্বরের আইপিডিআরে তার অবস্থান সেতুর ওপর অনুমান করা হয়।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন জানালো যে ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন, সেটি তার পরিবার ও সহপাঠীরা মেনে নেননি। নেননি বলে বুয়েট শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তখন শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে তথ্য-প্রমাণ ও সিসিটিভি ফুটেজ দেখার অনুরোধ করে ডিবি। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ডিবি কার্যালয়ে যান বুয়েট শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া ছেলের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মানতে নারাজ ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা।
তিনি বলেছেন, ফারদিনকে হয়তো এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে বন্দুকের মুখে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছে। তাকে অপরাধীদের নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য করা হতে পারে...। তদন্তকারীদের উচিত আমাদের সব জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ দেখানো...। যে ছেলে রাত ১১টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসত, সে কেন এসব সন্দেহজনক স্থানে এভাবে ঘুরবে, প্রশ্ন বাবার।
ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই এটা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে তিনি খুন হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফেও এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একটা ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বলল যে ফারদিন সেতুর ওপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। একই দিনে সংবাদ সম্মেলনে একই কথা বলল র্যাবও। তার মানে ঘটনা এখানেই শেষ নাকি শুরু?
প্রশ্ন হলো, সেতু থেকে লাফ দেয়া ব্যক্তিটি যে ফারদিন, সেটিও কি নিশ্চিত? প্রশ্নটা এ কারণে যে, আত্মহত্যা করার জন্য সারা ঢাকা শহর ঘুরে নারায়ণগঞ্জের একটি সেতুর ওপরে উঠে ফারদিনকে ঝাঁপ দিতে হলো কেন? আত্মহত্যার আর কোনো পথ তার জানা ছিল না?
একসঙ্গে গোটা দশেক ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কিংবা ঢাকা শহরের কোনো রেললাইনে শুয়ে থাকলে অথবা কোনো উঁচু ভবন থেকে নিচে লাফ দিয়েও আত্মহত্যা করা যেত। এসব পথে না গিয়ে ফারদিন এত জটিল পথে কেন হাঁটলেন? তিনি কি জীবন নিয়ে অনেক বেশি জটিলতায় আক্রান্ত ছিলেন? এইসব প্রশ্নের খুব সহজ উত্তর নেই বলেই ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়টি বিনা বাক্যে মেনে নেয়া কঠিন।
কঠিন বলেই ডিবি ও র্যাব যেদিন ফারদিনের আত্মহত্যার কথা জানালো, সেদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই এই ঘটনাকে ‘স্ক্রিপ্ট দুর্বল’ বলে তির্যক মন্তব্য করেছেন। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘দূষিত রাষ্ট্রে ফারদিন মৃত্যুর আগে দূষিত পানি খেয়ে মরতে চেয়েছিল বলেই হয়তো সেতুর ওপর থেকে দূষিত পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে।’ মানুষের এই নির্মম রসিকতার ভেতরেও আসলে আছে ক্ষোভ, অবিশ্বাস, অনাস্থা, যেটি একদিনে তৈরি হয়নি। যেমন আরেকজন লিখেছেন ‘সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে গভীরে যেতে হবে।
আর গভীরে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে। রাষ্ট্র হয়তো সাপ বের করতে চায় না।’ আসলেই কি তা-ই? সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ার পেছনেও মূল কারণ কি এই সাপ বেরিয়ে আসার ভয়? একজন লিখেছেন, ‘মুনিয়ার হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালানো গেছে। তাহলে ফারদিনের হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালানো যাবে না কেন?’
সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা লিখেছেন, ‘বস্তুত কিছু ঘটনা এমনভাবে ডিল করা হয়, এমন কথাবার্তা বলা হয় যে, মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না। আর হলেও যে তদন্তের ওপর ভিত্তি করে হবে সেটা মানুষ বিশ্বাস করবে না। ফারদিনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করেও এই জায়গাটা তৈরি হয়েছে। প্রথমে তার বান্ধবীকে সন্দেহ করা, তাকে হয়রানি করা, কারাগারে পাঠানো ছিল নাগরিক নিপীড়নের খোলামেলা দৃষ্টান্ত। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের উদ্যম ছিল খুবই তথাকথিত। শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছামৃত্যুর যে তথ্য উপস্থাপিত হলো- সত্য হলেও সেটা নাগরিক পরিসরে গৃহীত হচ্ছে না।’
প্রশ্ন হলো মানুষ কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথা বিশ্বাস করে না বা সন্দেহ করে? এই অনাস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পর্কে মানুষের গড়পড়তা ধারণা এখনো নেতিবাচক এবং তার পেছনে হাজারটা কারণ রয়েছে।
সুতরাং সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে সত্যি সত্যিই ডাকাতরা হত্যা করে থাকলেও এই কথা বললে যে কারণে কেউ বিশ্বাস করবে না, সেই একই কারণে এখন ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়টিও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তার মানে পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
অতএব শুধু সাগর-রুনি বা ফারদিনের হত্যা/আত্মহত্যার সঠিক কারণ বের করে আনার চেয়েও বেশি জরুরি যেসব কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা নষ্ট হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস গত অর্ধ শতাব্দী ধরে তৈরি হয়েছে, এক মাসে বা এক বছরে সেটি কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু শুরুটা তো করতে হবে।