Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

মুশতাকের লেখা কতোটা প্রভাব বিস্তারকারী ছিল?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২১, ০৮:৪৯

মুশতাকের লেখা কতোটা প্রভাব বিস্তারকারী ছিল?

মুশতাক আহমেদ। ফাইল ছবি

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার প্রায় ১০ মাস পরে কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যু হয়েছে মুশতাক আহমেদের, যিনি দেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের উদ্যোক্তা- যার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। 

মুশতাকের মৃত্যুটি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক; আগে থেকেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং এ কারণে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে নাকি গ্রেফতারের পরে রিমান্ডে বা জেলখানায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে, সেটি সঠিক তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুশতাক আহমেদ সোশ্যাল মিডিয়ায় কী লিখেছিলেন ও সেই লেখাগুলো আসলেই জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে কি-না? যদি মুশতাক আহমেদের লেখায় সরকারের কর্মকাণ্ড ও নীতির কিছু সমালোচনা বা তীর্যক মন্তব্য থেকেও থাকে, তাহলে সেটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে কি-না? রাষ্ট্র ও সরকার কি অভিন্ন? সরকার ও দলের মধ্যে কি পার্থক্য নেই? 

প্রশ্ন হলো, সরকারের নীতি ও কর্মকা-ের সমালোচনা করার অধিকার কি নাগরিকের নেই? যদি থাকে তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো বক্তব্যের কারণে একজন নাগরিককে জামিন না দিয়ে মাসের পর মাস কি জেলে পুরে রাখা যায়? যেখানে অনেক বড় অপরাধীও জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়, যেখানে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার পর অনেক অপরাধী গ্রেফতারও হয় না, সেখানে শুধু ফেসবুকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমালোচনা করা বা তাকে নিয়ে রসিকতা করার অপরাধে একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবন্দি করে রাখাটা কতটা যৌক্তিক বা নৈতিক?

তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, মুশতাক আহমেদের মতো একজন মানুষের ফেসবুক পোস্টে কি সরকারের পতন হয়ে যেত? তিনি যেহেতু রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন না এবং রাজনৈতিকভাবে কোনো দলের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন না; ফলে এরকম একজন লোক ফেসবুকে কী লিখলেন আর কী শেয়ার করলেন, রাষ্ট্র সেগুলো কেন উপেক্ষা করতে পারল না? 

মুশতাক আহমেদের ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখা যায়, গ্রেফতার হওয়ার তিন দিন আগে গত বছরের ৩ মে তিনি সর্বশেষ একটি স্ট্যাটাস দেন, যেখানে রসিকতা করে লিখেছেন: ‘আমার জুতাগুলা মনে করছে মালিক মনে হয় মারা গেছে কিয়েক্টা অবস্থা।’ এটি নিতান্তই ফান পোস্ট। এর সঙ্গে সরকার বিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই। একই দিন তিনি আরও কয়েকটি পোস্ট দেন। একটি এ রকম- ‘স্বাস্থ্য সচিব, ডিজিসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিস, কোনো লাভ নেই, তাও ভাল্লাগসে।’

‘কোনো কারখানায় আক্রান্ত বেশি হলে সেটি কিছুদিন বন্ধ থাকবে’- স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন একটি বক্তব্যসংবলিত সংবাদ শেয়ার করে সেখানে তিনি লেখেন- ‘এই সব নিউজ দেখার পর যদি আপনার মনের ভেতর কোনো রাগ না আসে, তাহলে বুঝবেন আপনে সাধারণ মানুষ থেকে ওলি-আওলিয়া পর্যায়ে চলে গেছেন। তেলাপোকাও একটা পাখি আর উনিও একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।’

আলোকচিত্রী সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা সম্পর্কিত একটি সংবাদ শেয়ার করে মুশতাক আহমেদ লেখেন- ‘তাও ভালো বেঁচে আছে!!! নিজের দেশে প্রবেশ অনুপ্রবেশ হয় কি করে?’

এর আগের দিন ৩ মে মুশতাক আহমেদ কয়েকটি পোস্ট দেন। সেখানে উল্লেখ করার মতো কিছু নেই। পয়লা মে একটি পোস্ট দেন এরকম: ‘করোনা কি যৌন রোগ যে সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়? এক এমপির কভিড-১৯ পজিটিভ। এ কারণেই সাধারণ রোগীরা তথ্য গোপন করে।’ একই দিনের আরেকটি পোস্ট: ‘কিছু কিছু প্রাণীর চেহারা টিভিতে দেখলেই মনে হয় জুতাটি খুলে ছুড়ে মারি। এই মানসিক সমস্যা আগে ছিল না।’

এ দিনের আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন- ‘আমাদের দেশ তো সিঙ্গাপুর ব্যাংকক ছিল। বিশ্বের রোল মডেল ছিল। মধ্যম আয়ের দেশ, কিছু দিনের মধ্যেই কানাডায় রূপান্তরিত হবার কথা; কিন্তু এখন শুনি ডাক্তারের পিপিই নেই, করোনা পরীক্ষার কিট নেই, সবাইকে পরীক্ষার সামর্থ্য নেই, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা  নেই, ঢাকার বাইরে কোথাও আইসিইউ নেই, নেই, নেই! হঠাৎ করে এত গরিব হয়ে গেলাম কীভাবে?’

৩০ এপ্রিলের একটি পোস্ট- ‘বাংলাদেশে পঙ্গপাল এসে সুবিধে করতে পারবে না, কারণ এখানে আছে চেয়ারম্যান, মেম্বার, অসাধু ব্যবসায়ী নামক বঙ্গপাল।’ একই দিন আরেকটি পোস্টে লেখেন- ‘তিন মাসের বেশি সময় ধরে ‘আমরা প্রস্তুত’; ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’ বলে হম্বিতম্বি করার পরে দেখা গেল যে, আসলে কোনো প্রস্তুতিই নেই। হাসপাতালের প্রস্তুতি নেই, বেড নেই, আইসিইউ নেই, অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।’ কিন্তু এসব পোস্টে জাতির পিতা বা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননাকর কিছু চোখে পড়েনি। বরং ২৩ এপ্রিল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনও তিনি শেয়ার করেছেন। তার মানে মুশতাক আহমেদ যদি সত্যিই বিএনপি-জামাতের পারপাস সার্ভ করতেন, তাহলে এই কার্টুন তার শেয়ার করার কথা নয়। 

বলা হচ্ছে, নিজের ফেসবুক ওয়ালের পাশাপাশি মুশতাক আহমেদ ও ধস ইধহমষধফবংযর নামে একটি ফেসবুক পেজে সরকারবিরোধী অনেক পোস্ট শেয়ার করতেন। প্রশ্ন হলো, এখানেও তিনি যা লিখতেন তার প্রভাব কতটুকু? তিনি গ্রেফতার হওয়ার আগে কতজন মানুষ এই পেজ সম্পর্কে জানত? ধরা যাক, তিনি করোনা ইস্যুতে আর দশজন নাগরিকের মতোই নিজের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছেন। এই ইস্যুতে তিনি যদি সরকারের কার্যক্রম ও নীতির এবং সরকারের নীতিনির্ধারকদের সমালোচনাও করে থাকেন, সেই অধিকারও নিশ্চয়ই তার ছিল।

তার লেখার ভাষা ও ভঙ্গি হয়তো আর দশজনের মতো নয়। কারণ সবার প্রতিবাদের ধরন এক নয়; কিন্তু সরকার বা সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমালোচনা করেছেন মানেই তিনি জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করেছেন; কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন- এমন উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। ধরা যাক, কিছু পোস্টে ব্যবহৃত তার ভাষা মার্জিত শোভন নয়। ধরা যাক তিনি যা লিখেছেন সেটি প্রচলিত আইনে অপরাধ; কিন্তু তারপরও শুধু ফেসবুকে লেখালেখি কিংবা শেয়ার করার কারণে কি কাউকে এভাবে মাসের পর মাস আটকে রাখা যায়? তার অর্থ কি এই যে, জামিন না পেয়ে তাকে কারাগারেই মরতে হবে? 

তাহলে কি মুশতাকের বিরুদ্ধে আরও বড় কোনো অভিযোগ আছে? কী সেটি? তিনি ছিলেন দেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের উদ্যোক্তা। সেই ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কি তার এমন কোনো বিরোধ ছিল! যার ফলে তার প্রতিপক্ষ সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বক্তব্যগুলোকে ইস্যু করতে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন? তিনি কি এমন কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মহলের বিরাগভাজন হয়েছেন- যাদের প্রভাবে তিনি জামিন পাননি? এসবই জানা যাবে, যদি সত্যিই একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হয়।

ফেসবুকে লেখালেখির কারণে এ পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে, তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন; তারা কতটা রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে আর কতটা সামাজিক দায় থেকে এসব লিখেছেন; তারা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে ব্যবহৃত হয়েছেন কি-না ইত্যাদি। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি বা সরকারের সমালোচনা করলেও কিছু লোক কেন ভিকটিম হচ্ছেন, এর পেছনে কোন কোন বিষয় ক্রিয়াশীল ছিল, তাও জানা দরকার।

এ কারণেই এই প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার যে, রাষ্ট্র কেন মুশতাক আহমেদের মতো একজন আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতাহীন এবং সরাসরি কোনো সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বা উগ্রবাদী সংগঠনের সক্রিয় কর্মী না হওয়া সত্ত্বেও তাকে এতটিই শত্রুজ্ঞান করল যে, শুধু ফেসবুকে কিছু কথাবার্তা লেখা এবং কিছু কথা ও কার্টুন শেয়ার করার জন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলখানায় রাখল। আর সেখানেই তার মৃত্যু হলো? তার মতো লোকেরা যদি ফেসবুকে সারাদিনও সরকারের সমালোচনা করতেন বা সরকারের দায়িত্বশীল লোকদের নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করতেন, তাতেও কি সরকারের পতন হয়ে যেত?

সরকারকে কেন এত মামুলি বিষয়েও সিরিয়াস হতে হয়। এসব জিনিস কি উপেক্ষা করা যেত না? মুশতাক আহমেদের নাম দেশের হাতেগোনা কিছু মানুষ জানতেন; কিন্তু জেলখানায় মৃত্যু পরে সারাদেশ তো বটেই, বহির্বিশ্বের মানুষও তার নাম জেনেছেন। মুশতাক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা শিরোনাম করেছে: Bangladeshi Writer, Detained Over Social Media Posts, Dies in Jail. 

হার্ট অ্যাটাকে মুশতাকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকলেও বহির্বিশ্বের মানুষ ধরে নেবে, তিনি রাষ্ট্রীয় নির্যাতনেই নিহত হয়েছেন। এটি কি বাংলাদেশ এবং বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি মোটেও উজ্জ্বল করল? না কি যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেটিই ক্ষুণ্ন করলো?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫