সার্ক এখন কারও না

গত পনেরো আগস্ট ছিল এক আজব ঘটনার দিন। ২০ বছর ধরে পরাক্রমশালী আমেরিকা আফগানিস্তানে এক পুতুল সরকার গঠন করে শাসন করে আসছিল। কিন্তু এই পুতুল সরকার যার প্রটেকশনে ক্ষমতায় ছিল সেই আমেরিকা নিজেকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ায়, ‘তালেবানেরা কাবুল দখলে আসছে’ এই আওয়াজ শুনেই গনি সরকার শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর সত্যিই তালেবান যোদ্ধারা শহর দখল করে এবং ক্ষমতা নিয়ে নেয় ১৫ আগস্ট।

আসলে যে সরকার তাকে উৎখাত করতে কেউ এগিয়ে আসছে শুনে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং তার সেনাবাহিনীও কোনও প্রতিরোধে এগিয়ে আসে না, সেটা মুরোদহীন সরকার। আর যার নিজেকে রক্ষার মুরোদ নাই সেটা সরকারই নয়। 

সরকারের বৈধতার প্রথম ধাপ হলো মুরোদ, যে মুরোদের সোজা অর্থ গায়ের জোর, নিজেকে রক্ষার সক্ষমতা। এরপরের ধাপ হলো, জনসমর্থনে ওই সরকারের পক্ষে জন-অনুমোদন নেয়া। তবেই সেটা এক বৈধ সরকার হয়। তাহলে আশরাফ গনি সরকারের নিজেকে রক্ষার মুরোদ ছিল না, এই হলো গোড়ার সমস্যা। 

ট্রাম্পের আমলে এসে আমেরিকা আফগানিস্তান ‘ফেলে’ পালাতে চাচ্ছিল। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই আফগান থেকে পালানোর জন্য তালেবানের সাথেই এক আপোষনামা সই করেছিলেন গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০। কিন্তু ট্রাম্প এই চুক্তি করেছিলেন গনি সরকারকে উপেক্ষা করে, তাকে কোনও পক্ষ না করেই। কারণ এটাই ছিল তালেবানের শর্ত। 

এই যে গনি সরকারকে উপেক্ষা করে তালেবানের সাথে চুক্তি সই করা- আসলে সেদিন থেকে এর সোজা মানে হয়ে গিয়েছিল; আমেরিকান প্রটেকশনে তারা আর পুতুল সরকারও থাকে না। সরাসরি বললে, ওইদিন থেকে গনি সরকারকে আমেরিকাও সরকার মানতে অস্বীকার ঘোষণা করে দিয়েছিল। তবে কেউ গনি সরকারকে ঠেলে ফেলে দেয়া বা চ্যালেঞ্জ দেয়নি বলে বাইরে থেকে দেখে এটাকে আগের মতোনই মনে করছিল। আর এই মোহে ছিল ভারত সরকারও।  

যদিও বাস্তবতা ছিল ট্রাম্প গনি সরকারকে এতিম করে ছেড়ে দিয়েছিল, কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়েছিল। গনি সরকারকে সাথে না রেখে কেবল তালেবানের সাথে চুক্তি করার মানেই হলো ট্রাম্প স্বীকার করে নিয়েছিলেন গনি সরকার বলে কেউ নাই, তালেবানেই আফগান ক্ষমতার একমাত্র হকদার। অথচ ১৫ আগস্ট সবাই এমন ভান করতে থাকল যে ওইদিনই বোধহয় প্রথম গনি সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলো আর তালেবান ক্ষমতা পেল। এজন্য বলছি ১৫ আগস্ট হলো এক আজব দিন! 

এখন ভান করাদের মধ্যে ভারত সরকারকে আমরা শীর্ষে রাখতে পারি। কেন? কারণ তারাও আমেরিকান ক্ষমতার দিকে চেয়ে থাকা বা আমেরিকার আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখা পার্টি। এখন তারাও নিরুপায়। অতএব তারা ভান করছে বা মনে করছে যে গনি সরকারই বৈধ সরকার। তবে আমেরিকান ক্ষমতার আড়ালে বসে আফগানিস্তান থেকে যারা ব্যবসা আর প্রজেক্ট লুটছিল ভারত সরকার তাদের অন্যতম।

কিন্তু আবার সাবধান! এখন সব অর্থেই কার্যত ‘গনি সরকার’ বলে আর কেউ নাই। কিন্তু এর মানে কি তাহলে আপনাতেই তালেবান বৈধ সরকার? অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের বা জাতিসংঘের মেনে নেয়া অর্থে? অবশ্যই না। যদিও কার্যত তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায়। 

আর নিজেদেরকে বৈধ সরকার বলে খুঁটি গাড়তে যেসব বাধা তালেবানের সামনে এর তালিকাটাও ছোট না। যেমন- এক) তালেবান এখনও নিজেরাই ক্ষমতার শপথ নিতে পারে নাই; শপথের আনুষ্ঠানিকতা করতে পারে নাই। দুই) সেই আনুষ্ঠানিকতায় আবার কাদের দাওয়াত দেবে, এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো -দাওয়াত দিলেই সে আসবে এর নিশ্চয়তা এখনো নাই বলে মনে হচ্ছে। তিন) দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় তাদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ আছে এমন অনুমান ছড়িয়ে আছে আর, ওদিকে শপথ অনুষ্ঠান হচ্ছে না বলে সেই অনুমানই আরও পোক্ত হয়ে চলছে। চার) সর্বশেষ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো বা না-ভেটোসদস্য সবাই মিলে মোট ১৫ সদস্যের সমর্থনে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব যা আহবান রেখেছে তা হলো, সবাইকে নিয়ে ইনক্লুসিভ ও মানবাধিকার রক্ষার পক্ষের এক সরকার গড়তে। অর্থাৎ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বৃটেন ও ফ্রান্স- এই পাঁচ ভেটোসদস্য একসাথে এই প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, যা খুব কম ঘটে থাকে। আর বলা বাহুল্য এটা তালেবানের ওপর খুবই শক্ত চাপ। ছয়) আমাদের অনেকের ধারণা, আমরা মুরোদে কুলালে যেমন ইচ্ছা কোনও সরকার গঠন করে বসতেই পারি, যেমন ইচ্ছা তা চলতে চালাতেও পারি, আমারটাই ভাল বা শ্রেষ্ঠ মনে ঠাউরে। কিন্তু এই অনুমান ভুল ও ভিত্তিহীন। একটা সমাজেও আমরা এভাবে টিকতে বা থাকতে পারব না। এছাড়া এটা উল্টা আমাদেরকেই একঘরে করে ফেলতে পারে। ফলে এমন চিন্তার কারণেও এনিয়ে একটা স্থবিরতা চলছে। সাত) মূল সমস্যা, তালেবান এক আমিরাত (আমীরের) সরকার-  অর্থাৎ আমিরাতে আফগান সরকার চাইছে। যদিও তারা জনপ্রতিনিধির সরকার না রাজা হবেন তা স্পষ্ট করতে পারছেন না। যদিও ঝোঁক রাজা বা আমীর হবার। [যদিও আমীর হলে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেবে না।] 

সার্ক 

তবে সর্বশেষ এক মহড়া হয়ে গেছে গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বৈঠকের সাইড লাইনে। আফগানিস্তানকে সার্কে সর্বশেষ যুক্ত সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে নেয়া হয়েছিল আগেই। সংশ্লিষ্ট নেতারা সার্কের একটি বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি মূলত আফগানিস্তানকে সেখানে ডাকা হবে কি না বা হলে কীভাবে এনিয়ে অমীমাংসিত বিতর্কের কারণে। 

এমনিতেই গত ১৫ আগস্টের পরে ভারত আফগানিস্তান ইস্যুতে একা হয়ে এক আজিব অবস্থান নিয়েছে। তা হলো অনেকটা যেন ‘আমাকে আগের গনি সরকার এনে দাও। আমি এর অন্য কমকিছু হলে মানব না’- টাইপের।  সম্ভবত এর মূল কারণ এতদিন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার আড়ালে থেকে আফগান ইস্যুতে অবাধ বিচরণ ও সুবিধা খেয়েছে। আর এখন ঠিক উল্টা যুক্তরাষ্ট্রও কারও দিক না চেয়ে কেবল নিজের একক  স্বার্থের দিক চেয়ে চলার কারণে ভারত একা বোধকরা এক এতিম যেন! তাই সার্ক মিটিংয়ে ভারতের অবস্থান ছিল, আগের নাই হয়ে যাওয়া গনি সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব আনতে হবে। 

আর ভারতের দাবি পাকিস্তান তালেবানকে ওই প্রতিনিধিত্বের আসনে বসাতে চেয়েছে তাই। সারকথা ওই বিতর্কে পড়ে, সার্কের সভা বসতেই পারেনি; বাতিল হয়ে গেছে।

কিন্তু ভারতের মিডিয়া এ নিয়ে অস্থির অধৈর্য হয়ে উঠেছে। যেমন দ্যা প্রিন্ট পত্রিকায় জ্যোতি মালহোত্রার এক লেখা। [অনুমান করা হয় এটি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লেখানো।] তারা নিজেরাই এর সারাংশ সেখানে করেছে এভাবে: ‘চীন আর সার্ক রুমের মধ্যে ঢুকে পড়া হাতি নয়। বরং সে ওর পুরা ঘরবাড়িই দখল নিয়ে বসেছে। ভারতের বরং উচিত হবে তার পড়শিদের ছেড়েছুড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইউকে, রাশিয়া প্রভৃতি অগ্রসর দেশ ও কোয়াডের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া।’

এসব কিছু আসলে ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের এলায়েন্স গড়ে তোলা, যার ভিত্তি হল কথিত ‘সন্ত্রাসবাদ’ ইস্যু। আর এতে এর নামে ভারতের অদ্ভুত এক মুসলমানবিদ্বেষী মন আর সেই মনের তৈরি করা ঘৃণা হাজির হয়েছে! যুক্তরাষ্ট্রও প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ভারতের এই আচরণ সমর্থন করে গেছে আর আজ এরই পরিণতি দেখছে সবাই। 

আসলে একালের আফগান থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের পরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে তার গত ২০ বছরের সম্পর্ককে পুনঃমুল্যায়নে ঢেলে সাজিয়ে নেয়া শুরু করাতে ভারতের এই দিশাহীন প্রতিক্রিয়া। 

এক্ষেত্রে সার্ক হল সেই সংগঠন যার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, অর্থাৎ ২০০১ সালের আগে। এদিকে ২০০১ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতার আড়ালে, মার্কিন সমর্থনে ভারতের মুসলমান ও পাকিস্তানবিদ্বেষ চরমে ওঠাতে ভারত আর সার্ক টিকাতেই চায় নাই। এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ, নয়াদিল্লিতে সরকারি আমন্ত্রণে ২০১৬ সালে ভারত সফররত একদল বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় সাবেক রাষ্টদূত পিনাক রঞ্জন খোলাখুলি বলেই ফেলেছিলেন, সার্ক ভুলে যান; আর ‘বিমসটেক জোটের’ ওপর বাংলাদেশ জোর দিক।  

এটা প্রমাণ করে ভারতের বিদ্বেষী আচরণ কোন মাত্রা ছুঁয়েছে। একালে এর উপর যুক্ত হয়েছে আমেরিকা আর আগের মতো ভারতকে সমর্থন করতে পারছে না, সম্পর্ক আর আগের মতো নাই। আমেরিকা নিজের স্বার্থ নিয়েই ডুবে আছে। আর সে ভিত্তিতেই ভারত-আমেরিকান সম্পর্ক ঢেলে সাজাতে চাইছে। আর এতেই ভারতের প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত ও ভয়াবহ! 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //