
এম আর খায়রুল উমাম
করোনা মহামারিতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আবার খুলেছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আর কোলাহলে মুখর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ দেশের সাধারণ মানুষ আনন্দিত।
মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কিছুদিন পরপর ছুটি বৃদ্ধির ঘোষণা করে যায়। আবার শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে থাকতে পারে তার জন্যও নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে এসব উদ্যোগের ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা খুব উপকৃত হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। শিক্ষাবিদদের বিবেচনার ফলস্বরূপ করোনা মহামারিকালে গড়ে তোলা শিক্ষাদান পদ্ধতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোন উপকারে লেগেছে তা না বুঝতে পারলেও, এই বিশাল ছুটিতে তারা যে বইমুখী ছিল না এটা পরিষ্কার। তাই শিক্ষার্থীদের বইমুখী করার উদ্যোগ দেশ ও জাতির স্বার্থে করা জরুরি।
দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে গড়ে ওঠা মানসিকতায় বইমুখী ব্যক্তি খুবই কম। সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে জানার প্রবণতা গড়ে না ওঠার কারণে পড়ার মানসিকতাও দেখা যায় না। সমাজ বিশ্বাস করে যারা আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ তারাও সিংহভাগ বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। আমাদের বই মেলার কলেবর বেড়েছে, সরবরাহ প্রচুর, বাসা-বাড়িতে বইয়ের প্রদর্শনী বেড়েছে, পত্রিকা ও সাময়িকী বেড়েছে, নতুন নতুন বিষয় এসে বিষয়সংখ্যা বেড়েছে, পাঠাগার বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, বই-পত্রিকা-সাময়িকীর বিক্রিও বেড়েছে। এতসব বৃদ্ধির মধ্যে আনুপাতিক হারে পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এসব নিয়ে দেশে কোনো সমীক্ষা হয়েছে এমনটাও চোখে পড়েনি। ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো সমীক্ষা হলেও তা প্রচারে আনা হয়নি। তাই প্রকৃত পরিবেশ জানার জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানাদির দিকে তাকালে দেখা যায় গুণগত মান প্রশ্নসাপেক্ষ।
সাম্প্রতিক সময়ের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও এর থেকে ব্যতিক্রম ভাবার কোনো সুযোগ নেই। মিডিয়াতে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করা কিছু নির্ধারিত মানুষ ঘুরে ফিরে আসলেও স্থানীয় পর্যায়ের একটা দল সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। এসব আলোচনার গভীরতা-প্রাসঙ্গিকতা-আধুনিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও সমাজে এ মানুষগুলো রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক বোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে থাকেন। এখানেও বিষয়কে গুণগত মানসম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় বইমুখিতার অভাব প্রকট। সমাজ যখন এভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে সেখান থেকে সাধারণ মানুষ কী শিক্ষা গ্রহণ করে বইমুখী হবে?
কিছুদিন আগে এক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠাগারে গিয়েছিলাম। ৫০/৬০ বছরের পুরনো এবং সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া বিশেষায়িত শিক্ষার শিক্ষায়তন হিসেবেই সেখানে গিয়েছিলাম। এ বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজনীয় বইয়ের বাজারমূল্য অত্যন্ত বেশি এবং তা সহজলভ্য না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠাগারটি খুব প্রয়োজনীয়। কিন্তু পাঠাগারে বইয়ের অভাব হলেও নোট বইয়ের কোনো অভাব নেই। ৫০ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে পাঠাগারের কোনো সদ্ভাব নেই। বাতিল হয়ে যাওয়া বইগুলো একপাশে ধুলো ময়লার মধ্যে পড়ে থাকলেও নতুন বই হিসেবে জ্বলজ্বল করছে নোটবইগুলো। তবে এই নোটবইগুলোর দিকে তাকালে একটা বিষয় খুব আনন্দ দেয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তির উপস্থিতি। এক একজন ব্যক্তির গণ্ডায় গণ্ডায় ডজন ডজন বিষয়ের বই।
ভাবি আমি নিজে অধম বলে কেউ কি উত্তম হবে না? কিন্তু যখন চিন্তা করি কেপি বোসের পাটিগণিত বা ল্যাডলি মোহনের রসায়ন বইয়ের কথা তখন এসব অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা আলাদাভাবে ভাবতেই হয়। এ অবস্থা শুধু পাঠাগারে নয়, একজন শিক্ষক আছেন, নতুন কেউ তার বাসায় গেলেই কাঠের আলমারি খুলে বই দেখিয়ে বলেন উনার ২২টা বই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। জানি না এসব পাঠ্য বইয়ের অবদানে আমাদের শিক্ষার্থীরা কী অবস্থায় আছে। সে বিতর্কে যেতেও চাই না।
করোনা মহামারির কারণে সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দিলেও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার জন্য অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে এই ব্যবস্থা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সাথে আমাদের কিছু বিদ্যমান মানসিকতার কারণে শিক্ষার্থীর জন্য অনলাইন শিক্ষা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। অনলাইনে শিক্ষার জন্য একটা স্মার্টফোনের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ যেমন জরুরী তেমনই বিদ্যুতপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু মৌখিক আশ্বাস ছাড়া বাস্তবসম্মত আর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছে। ফলে দরিদ্র অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনায় সহায় সম্পদ বিক্রি করে কষ্ট করে একটা স্মার্টফোন সংগ্রহ করলেও সবাই ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়নি। মোবাইল কোম্পানীগুলো ইন্টারনেটের মূল্য ও সময় নিয়ে যে খেলায় মত্ত তাতে কোনো রকম হস্তক্ষেপ ক্ষমতার বলয় করেনি। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে অনলাইন শিক্ষা অধরাই রয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেওযথাযথ সঞ্চালনের অভাবে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো যায়নি। তবে অনলাইন শিক্ষার মূল সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউই এ শিক্ষায় অভ্যস্ত নয়। সরকারি উদ্যোগে সবাই সাধ্যাতীত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফলপ্রসূ হচ্ছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বিত্তবানরা এই শিক্ষায় উপকৃত হলেও দেশের নিম্নশ্রেণির মানুষের ঘরে কোনো ফসলই উঠেনি। তাই শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াই ভুলে গিয়েছে, বই পড়া তো অনেক দূর।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সময়কালে অ্যাসাইনমেন্ট বেসিস পড়াশোনা চালু করেছে। আমাদের ক্ষমতার বলয় জানেন কিনা জানি না যে স্বাভাবিক সময়েই প্রথম শ্রেণীর ড্রইং খাতা, দশম শ্রেণীর বিজ্ঞানের খাতা শিক্ষার্থীরা নিজেরা প্রস্তুত করে না। অর্থের বিনিময়ে এসব খাতা সুন্দর করে প্রস্তুত করার পর জমা দেওয়া হয়। এসব আমাদের অভিভাবকরা যেমন জানেন, তেমনি শিক্ষকরাও তা বোঝেন। তারপরও কেউ কোনো রা করেন না, গাও করেন না। আমাদের দেশের দুর্নীতির অবস্থান বিবেচনা বিতর্কের মধ্যে না জড়িয়ে শুধু জানতে ইচ্ছা করে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক মূল্যায়ন কতটা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করবে? বিত্তবান পরিবারের শিক্ষার্থীরা এসব পদ্ধতিকে ভালো ফলাফলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে অবাক হওয়া ছাড়া হাতে করণীয় কিছু থাকবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধির পাশাপাশি ছুটি শেষে পরীক্ষার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছে সেই মার্চ ২০২০ সাল থেকে। করোনা মহামারির প্রকোপ বাড়া-কমার মধ্যে থাকার এক পর্যায়ে কওমি মাদ্রাসা খুলে দিলেও সাধারণ শিক্ষা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এই দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে দেশ বিশ্বের রোল মডেল হয়ে গিয়েছে। যদিও এখনো বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা আসেনি। তবে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যথারীতি এগিয়ে চলেছে। এখনকার শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি। তাই ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের সন্তানদের বিদেশে অথবা দেশে ইংরেজি মাধ্যম কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা অনুমান করতে সক্ষম হয়েছেন তা বলার খুব একটা সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ভাবনায় গৃহীত কার্যক্রমে আমাদের শিক্ষার্থীরা কিন্তু বাসায় থাকার সুযোগই পায়নি। প্রায় সব বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক কোচিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, যেখানে কেউ অনুপস্থিত থাকতে পারবে না। বিদ্যালয় খুলতেই পরীক্ষা, তাই অভিভাবকরাও সন্তানদের কোচিংয়ে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশনি চলেছে সগর্বে। শহরে কিছু শিক্ষক আবার অনলাইন টিউশনিও চালু করেছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, সাধারণ শিক্ষার ব্যবসায়িক দিক পুরাপুরি সক্রিয় থাকার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি জোরালো হয়নি। করোনা মহামারির ব্যাপকতার মধ্যে অনেক দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েও আমরা ছুটি দিয়ে তা বন্ধই রেখেশিক্ষার্থীদের তথা শিক্ষা ব্যবস্থার কোন উপকার করলাম তা বিবেচনা করে দেখা জরুরী।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা বইয়ের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। যদিও পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রমের ফলে ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষার্থীরা বইয়ের চেয়ে নোট নির্ভর অনেক বেশি। অভিভাবক ও শিক্ষকরাও এ ব্যবস্থাতেই বেশি নির্ভরশীল। আমাদের কোচিং, প্রাইভেট টিউশনি বা সম্প্রতি সময়ের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কোনোটাই বই নির্ভর নয়। নোট বই প্রীতির কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পরও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে সমাদৃত করা যায়নি।
একটানা ৫৪৪ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, শিক্ষক-অভিভাবকদেরও শারিরীক-মানসিক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনকে কাজে লাগিযে অর্জিত শিক্ষাকে মানসম্মত করতে সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বিশাল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে।
এখানে বই কমবে, পরীক্ষা কমবে, শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন ১০টা বিষয় পড়বে। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে এবং মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য সফল করতে বই হোক পথপ্রদর্শক। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে আমাদের শিক্ষার্থীরা বইমুখী হোক।
লেখক- সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ