Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দুবাইয়ে শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে চালু

Icon

গৌতম দাস

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১১:১৪

দুবাইয়ে শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে চালু

গৌতম দাস

পারস্পেকটিভ শব্দটি ইংরেজি, যার বাংলা পরিপ্রেক্ষিত; তবে সহজ বাংলা হলো ‘কোথায় বসে দেখছেন’। মানে একটি ঘটনা কোথায় বসে দেখছেন, তাতে ঘটনার অর্থ-তাৎপর্য ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। গত ৭ জানুয়ারি ছিল এ বছরের প্রথম শুক্রবার। আর ইউনাইটেড আরব আমিরাত (ইউএই) যেটা আসলে সাত আমিরী ভূখণ্ডের এক ফেডারেশনের নাম ও যার রাজধানী আবুধাবি। আর এভাবে দুবাইও আরেক আমিরী (আমিরাত) ভূখণ্ড। আমরা এই দুবাইকেই বেশি চিনি। এই ইউএই (একে এরপর থেকে সংক্ষেপে আমিরাত বলব)-তেই গত শুক্রবার থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার-শনিবার থেকে সরিয়ে শনি-রবিবার করা হয়েছে।

এ নিয়ে সাতটি পত্রিকা ঘেটে দেখার পর জানা গেল আসল কারণ। যদিও সবক্ষেত্রেই নিউজের উৎস ছিল পশ্চিমা নিউজ এজেন্সি, এক্ষেত্রে তা এএফপি অথবা এপি। তবে সেসব ছাপা হয়েছে পশ্চিমা দেশের, মধ্যপ্রাচ্যে বা পাকিস্তানের পত্রিকায়। যার মধ্যে আবার কেবল নেগেটিভ প্রতিক্রিয়াকে হাইলাইট করে নিউজ করা হয়েছে পশ্চিমা পত্রিকায়। যেগুলো আসলে মানুষ যেমন বলে যে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, সে ধরনের। যেমন শুক্রবার সকালে অফিস যাওয়াকে কেন্দ্র করে কারও এক টুইট মন্তব্য ছিল, ‘ইট জাস্ট ফিলস সো রঙ’। মানে ‘বারবার কেবল মনে হচ্ছে এটা ঠিক না’। আর গার্ডিয়ান ও স্কাই নিউজরা এই কথাগুলোকেই শিরোনামে নিয়ে এসেছে। এরা বাদে বাকি সবাই আসলে মূলত ফ্যাক্টসগুলোকেই শিরোনাম করেছে। 

তবে ব্যতিক্রম পাকিস্তানের দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকা। এই ট্রিবিউনই আসলে মুখ্য কিছু ফ্যাক্টসকে সামনে এনে তাদের রিপোর্ট করেছে। আমিরাত বা দুবাই মুসলমান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম লিডার দেশ; অন্তত পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বিজনেস কানেকশনে ব্যপ্তির দিক থেকে যে বাকি মধ্যপ্রাচ্য দেশের সবার চেয়ে এগিয়ে। আফ্রিকার আর এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মিলিয়ে মোট দেশ হয় প্রায় ৬৫টি। এসব দেশে যে কোনো বাইরের পণ্য প্রবেশের ডিস্টিবিউশন সেন্টারহল দুবাই। এ ছাড়াও আরেকটি দিক, আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটের বাইরে আরও দুটি দেশে একালে গ্লোবাল ‘পুঁজি-বাজার’ বা বিনিয়োগ তৎপরতার কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। এমন একটি দেশ হল সিঙ্গাপুর।

কিন্তু এসব ছাড়িয়ে আমিরাত বা দুবাইয়ের মুসলমান পরিচয়টি সামনে এনে দেখার কারণে শুক্রবারকে কাজের দিন বানানোটাই যেন এখানে মুখ্য বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে মিডিয়া রিপোর্টে। ফলে এ নিয়ে প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্ন হাসি-ঠাট্টা টিটকারি বেশিরভাগ মিডিয়ার খবরের পারস্পেকটিভ করা হয়েছে। অথচ ট্রিবিউন যে ফ্যাক্টস বলছে তা হলো, দুবাইয়ে মূলত সাপ্তাহিক কাজের ঘন্টা কমানো হয়েছে। সপ্তাহে আগে মোট কাজের দিন ছিল পাঁচ দিন। এখন সেটি সপ্তাহে সাড়ে চার দিন করা হয়েছে। তবে শুক্রবার এখন কাজের দিন হলেও তা আসলে হাফ দিন মানে কেবল দুপুর ১২টা পর্যন্ত। আর সাপ্তাহিক ছুটি এখন শনি-রবিবার। এ ছাড়া সঙ্গে সরকার থেকে এই পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে এক স্টেটমেন্টও দেওয়া হয়েছে। 

তাতে বলা হয়েছে, ‘উইক অ্যান্ড হিসাবে যেসব দেশ শনি-রবিতে অভ্যস্ত সেসব দেশের সঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল, ট্রেড ও ইকোনমিক লেনদেনের বাধা ও অসুবিধাগুলোকে সহজ করতে এটি করা হয়েছে। যাতে হাজারো দুবাইভিত্তিক বা বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক বিজনেস লিঙ্ক ও এর সুবিধাদি শক্তিশালী ও সহজতর করা যায়।’

আসলে শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে না হলে আগে কী অসুবিধা হতো? শুক্র-শনি-রবি এই টানা তিন দিন কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক তথ্য চালাচালি কমিউনিকেশন আদান-প্রদান বা ব্যাংক লেনদেন একেবারেই বন্ধ থাকত। এখন অন্তত মাঝের হাফ দিন (শুক্রবারেও) তা চালু থাকবে। আর এটুকু পেতেই সাপ্তাহিক কাজের ঘণ্টা বাকি আর্ধেক দিন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সেজন্য সরকার এটাকে বলছে, মানুষের ‘কাজ ও জীবনের মধ্যে ব্যালেন্স’ আনার চেষ্টা।

গত প্রায় পঁচাত্তর বছরে দুনিয়ার জীবনযাত্রায় ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। এর একটি হলো নিজ নিজ দেশে অন্যের কলোনি বা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা আর নয়। কলোনি দখল সম্পর্কেরই আনুষ্ঠানিক ও আইনগত সমাপ্তি টানা হয়ে গেছে। এর বদলে, বরং নিজ স্বাধীন দেশে থাকা আর গ্লোবাল কানেকটেড জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে বসবাস আজ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই বিচারে ১৯৪৫ সাল প্রথম কলোনিমুক্ত দেশ ও জীবন এবং সঙ্গে একটি গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম এবং অর্থনৈতিক মুদ্রা বিনিময় সিস্টেমের মধ্যে বসবাসের শুরু।

দ্বিতীয় মোড় ঘোরার ঘটনাটি ছিল ১৯৮০ এর দশকের শুরু থেকেই চালু হওয়া গ্লোবালাইজেশন। যার নেগেটিভ দিকটি অনেকে প্রধান করে দেখে থাকে। কেবল নিজ দেশেই যা যা সম্ভব, তা নানান সীমাবদ্ধতায় উৎপাদন করে নিজেই ভোগ করে, এই জাতিবাদি ব্যবস্থার বিপরীতে নানান দেশের উৎপাদনগুলোকে আবার নানা দেশে ভোগ-বিতরণ- এভাবে সবকিছুরই এক গ্লোবাল বিনিময় ব্যবস্থার দিকে আমরা চলে গেছি। যার মূল দিকটি হলো গ্লোবাল এক শ্রম-বিনিময় চালু হয়েছে। আর সেখান থেকে প্রত্যেক উৎপাদক দেশের শ্রম মানে ‘এডেড ভ্যালু’, আর তা একই প্রডাক্টের ভেতরে এক দিকে সংশ্লিষ্ট সকল দেশের শ্রম ‘এডেড ভ্যালু’ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে আবার সেই ফাইনাল প্রডাক্টের ভোক্তা হচ্ছে ‘ভ্যালু এড’ করা সকল দেশ। এটাকে বলা হচ্ছে ভ্যালু এডেড চেইন, এই যোগে সংশ্লিষ্ট দেশের এক অর্থনৈতিক জোট। এমনই এক জোট হলো Regional Comprehensive Economic Partnership (RCEP)। স্বভাবতই এগুলো আগামী দুনিয়ার অভিমুখ। এবং দুবাই হয়ে উঠতে পারে এরই এক আঞ্চলিক ডিস্টিবিউশন কেন্দ্রদেশ।

এখন আমরা চাই আর না চাই গত চল্লিশ বছরব্যাপী এটা এতই বিকশিত জায়গায় চলে গেছে যে, পিছন ফিরবার পথ নেই। অনেকটা নদী পেরিয়ে এরপর নৌকাডুবিয়ে দেবার মতো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তবু এক উলটা পথে হাঁটার চেষ্টা করে ফেল করে গেছেন। কার্যত তার ‘আমেরিকান জাতিবাদ’ পরাজিত হয়ে গেছে। যদিও এর খারাপ পরিণতি-প্রতিক্রিয়া এখন এসে পড়েছে বাইডেনের ঘাড়ে, এখনকার ইকোনমিতে। যেটা এখনকার ভাষ্যে বললে এক ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। আমেরিকায় এবং গ্লোবাল প্রধান সমস্যা হিসেবে।

কিন্তু এগুলোর সঙ্গে দুবাইয়ের সাপ্তাহিক কাজের ও ছুটির দিন বদলের কী সম্পর্ক?

একালে আমেরিকার ওয়ার অন টেরর এক বিশাল প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, এতে মুসলমানদের বৈষম্যমূলক ট্রিটমেন্ট সহ্য করতে হয়েছে। অনেকে এটিকে মুসলিম আইডেনটিটির ভিত্তিতে কেবল মুসলমানের এক গ্লোবাল উত্থানের স্বপ্ন দেখছে। অনেকে এ থেকে প্রতিক্রিয়ায় এক গ্লোবাল খেলাফতে কায়েম হবে এমন স্বপ্ন-কল্পনাও হাজির হয়েছে বলছেন। যা আবার এর বাস্তবায়ন কেন সম্ভব বা কেন অসম্ভব সে আলোচনা পর্যন্ত উপেক্ষায় রাখা হয়েছে আমরা দেখছি। 

তবে এসব তর্ক উহ্য রাখা হোক আর নাই হোক, ওপরে গ্লোবাল অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যে অভিমুখ কিছুটা এঁকেছি সেই অর্থনৈতিক অভিমুখের সঙ্গে এই ‘গ্লোবাল খেলাফতের স্বপ্ন-কল্পনার’ সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে; কিন্তু এই সংঘাতের বিশেষত্ব হলো এটা এক বাস্তব ও অবজেকটিভ ফেনোমেনার (গ্লোবাল অর্থনৈতিক অভিমুখের) সঙ্গে কিছু মানুষের আইডিয়া বা কল্পনার সংঘাত। আর সবচেয়ে বড় কথা, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বাস্তব অবজেকটিভ ফেনোমেনাকে (যেমন জলোচ্ছ্বাসের মতো অবজেকটিভ ঘটনা) পরাজিত করা অসম্ভব হয়ে যায়। এসব কল্পনা যতটা অবাস্তব আন-রিয়েলিস্টিক তার হেরে যাওয়া বা টিকতে না পারার সম্ভাবনা তত বেশি। 

যেমন দুনিয়ার মূল অপ্রতিরোধ্য অভিমুখ হলো, দুনিয়ার সব কোণের সব শ্রম পরস্পরের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে লেনদেনে সম্পর্কিত হয়ে উঠতে চাইছে। শ্রম বা ভ্যালু যোগ হওয়া পণ্য বিনিময়ের ঘনিষ্ট হয়ে উঠতে চাইছে। এবং তাতে কার কী রাজনৈতিক, এথনিক, রেসিয়াল ধর্মীয় পরিচয় ইত্যাদি সব নির্বিশেষে মাখামাখি সম্পর্কিত হয়ে উঠতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে মুসলমান পরিচয়ে একটি আলাদা দুনিয়া, কিংবা নিদেনপক্ষে কোল্ডওয়ারের জমানার মতদুই ব্লক দুনিয়া খাড়া করার কল্পনা আন-রিয়েলিস্টিক। যেমন চাল আর ডাল মিশানোর আগে পর্যন্ত সব ঠিক আছে; কিন্তু একবার মিশিয়ে ফেললে তা আর আলাদা করা যায় না।

পুরানা সোভিয়েত ব্লক এখন ভেঙে গেছে শুধু না, তারা ১৫ রাষ্ট্রে আলাদা হয়ে গেছে। আবার ওই ১৫ সবাই এখন আইএমএফের সক্রিয় সদস্য। অর্থাৎ সারা দুনিয়াই এখন প্রায় সবদেশ একই গ্লোবাল অর্থনীতির সদস্য। তাই সবার সঙ্গে সবার সব ধরনের পণ্য-শ্রম-পুঁজি বিনিময়ের যোগ্য হয়ে গেছে। 

এমন সম্পর্কের আরেক উপযুক্ত উদাহরণ হলো, চীন-ভারতের অর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক। একদিকে এ দুই দেশের মধ্যে সামরিক, রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিক স্বার্থ সংঘাত বেড়ে চলেছে। উল্টা কথাটা হলো, ভারতে চীনাপণ্য আমদানি-বাণিজ্য গত তিন বছরে না কমে আরো বেড়েছে।

কাজেই এভাবে বলা যায় দুবাইয়ের ওয়ার্কিং-ডেতে বদল গ্লোবাল অভিমুখের সঙ্গে দুবাইয়ের আমীরেরা তাদের নিজেদের সমন্বয় করা উচিত বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এই পারস্পেক্টিভ থেকে দেখলে ও বুঝলেই কেবল অর্থবোধকভাবে অনেক কিছুই ফুটে উঠতে পারে।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫