Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

প্রেমের মরা জলে ডোবে না

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:০৪

প্রেমের মরা জলে ডোবে না

গাজী তানজিয়া

৪২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভ্যালেইনন্টাইনস ডে ধর্মীয় রিচ্যুয়াল হিসেবে পালিত হয়ে এলেও বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বহু দেশে ফেব্রুয়ারি মাসকেই ভালোবাসার হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন মৃত্যুদণ্ড বরণ করে নেয়ার মধ্য দিয়ে প্রেম নামক যে অনুভূতির অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, তার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে শুধু কি পুঁজিবাদের স্বার্থে? এর পেছনে কি আবেগ অনুভূতির মতো বায়বীয় কোনো অস্তিত্বের কৃতিত্ব নেই!  

স্লাভয় জিজেকের মতে, ‘ভালোবাসা ব্যাপারটা চরম দুর্ভাগ্যের মতো, একটা ভয়ঙ্কর পোকার মতো, এমন একটা স্থায়ী জরুরি অবস্থা যা সব ধরনের ছোটখাটো আনন্দ উপভোগ করাকে নষ্ট করে দেয়।’ আবার তিনি যে ভালোবাসা থেকে দূরে থাকেন বা থাকতে পারেন তাও কিন্তু নয়। তবে তিনি যাকে ভালোবাসেন তার মতে তাকে উদ্ধত আর তিক্ততার স্বাদ দিয়ে তা প্রকাশ করেন।

আবার প্রাচীন মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বলেছেন, “পৃথিবীতে ‘প্রেম’ নামক একটি শব্দমাত্র আছে ভগবান। কিন্তু তার বাস্তব অর্থ নেই। সংগ্রাম আছে, ক্ষুদ্র সুখ আছে, বিপুল দুঃখ আছে, অভিযান আছে, রাজ্য জয় আছে, কিন্তু ‘প্রেম’ নেই। হৃদয়ে হৃদয়ে সংযোগ সাধনের কোনো সূত্র নেই, তন্তু নেই, জরাবেষ্টিত পৃথক পৃথক রক্ত কুমুদের মতো মনুষ্যকুল ও জীবকুলের হৃদয়গুলো বিচ্ছিন্নভাবে সংসারের জলতলে ভাসমান।” 

তাহলে পৃথিবীতে আসলেই কি প্রেম বলে কিছু নেই। শুধুই কি মোহ, মায়া আর পিটুইটারির ক্ষরণ? তাহলে প্রেম নিয়েই বা এত কিছু, এত গান, গল্প, কবিতা, চলচ্চিত্র টিকে আছে কী করে? প্রেম প্রতিটি মানুষের ভেতরে এক শক্ত ভিত নিয়ে বসে আছে বলেই তো মনে হয়। আপাত দৃষ্টিতে আমরা তার দেখা পাই না ঠিকই। তবে প্রেম যে আছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। যদিও প্রেম নিয়ে নানা মুনির নানা মত, নানা দৃষ্টিভঙ্গি। তা ভেঙে ভেঙেই আজ এগোতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

বিখ্যাত লেখক গোগল, যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা প্রেমিকা বিয়োগের কারণে আত্মহত্যা করতে যান, তাদের পরামর্শ দিচ্ছেন- প্রেম কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। অন্যদিকে দস্তয়েভস্কি বলছেন, ‘ভালোবাসতে বাসতেও ঘৃণা করা যায়’।

তাহলে প্রেম কি অস্থায়ী ও সদা প্রবহমান? চোখের অলক্ষ্যে প্রেম ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে? আর বেঁচে থাকে শুধু ভালোবাসা নামের এক অলীক অনুভব! নাকি সে সময়ের স্রোতে বিলীয়মান কোনো অনুভবেরই নাম শুধু! 

ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী প্রেম যৌনতার অপর নাম হলেও মন নামের এক অস্তিত্বের কথাও তো তিনি বলেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পাশ্চাত্য দেশে মনকে আবিষ্কার করার প্রবণতা জন্মলাভ করেছিল। আর ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রমাণ করে দিলেন যে জীবাত্মাই বলো আর পরমাত্মাই বলো মানুষের ধর্ম বলো আর ভাগ্য বা পুরস্কার বল সবকিছুরই গাঁটছড়া বাঁধা রয়েছে ওই মনের কাছে। ‘আমার মন’ বললেও আমার আমিত্বটুকুর প্রায় ষোলো আনাই এই মনের মধ্যে বিরাজ করছে।

আর বাইরে যদি খানিকটা ‘আমি’ পড়ে আছি বলে মনে হয়, তাহলে সেটা মনের দোষ নয়, আমার মনে করার দোষ। সেই মনের নাগাল পাওয়া সহজ নয় বটে, কিন্তু পেলে জীবনের অনেক প্রহেলিকা সরল সহজ হয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তার প্যাবলভ, ফ্রোলব, ওয়াটসন প্রমুখ মনীষী মনকে একরকম অস্বীকার করে বসে আছেন। একদিকে বাহ্য পরিবেশ ও অন্যদিকে মস্তিষ্ক, নার্ভতন্তুসমূহ, রসগ্রন্থিসমূহ ও পেশিসমূহ দিয়েই মানুষের জীবনের সব চেষ্টা, জ্ঞান ও ভাবধারা উদ্ভূত হয় বলে তারা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন। 

আর এ যুগে এসে বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে জীবনমুখী গানের হোতারাও প্রেমকে শুধু পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষরণ বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। ভাগ্যিস পৃথিবীতে লেখক বলে এক সম্প্রদায়ের বাস আছে, নইলে প্রেম ভালোবাসা তো কবেই ফুরিয়ে যেত! ভালোবাসা প্রবলভাবে আছে বলেই তো দস্তয়েভস্কি বলতে পারেন, ‘নরক হলো ভালোবাসতে না পারার যন্ত্রণা।’

সঞ্জয় লীলা বানসালী দেবদাসের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে যুক্ত করেন, হাহাকার ভরা গান, ‘মন আমার মন/হায়রে মন/কাঁদে আমার মন।’

একই সঙ্গে জীববিজ্ঞানীদের মতে, মন তো আছেই, মন না থাকলে মনন, চিন্তাবৃত্তি কিছুই থাকবে না। তবে কোনো কোনো জীববিজ্ঞানীর মতে মানুষ ছাড়াও স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মধ্যেও মন বিরাজমান। সুতরাং ‘মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন’ এই কথারও তাৎপর্য আছে। সেখানে যৌনতার জন্য প্রেম থাকুক বা প্রেমের জন্য যৌনতা।

মূলত জৈবিকতার অপর নাম প্রেম বা ভালোবাসা যা একসময় বহু সাধুর কাছে পরিত্যাজ্য বা অশ্লীল হলেও পল থেকে প্লেটো, দান্তে থেকে গ্যেটে, ঘোসা থেকে নিটশে, কালিদাশ থেকে রবীন্দ্রনাথ, সুনীল থেকে হুমায়ূন সবাই পুলকিত অন্তরে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। তাই তো গ্যেটে অশীতিপর বয়সে এসে বললেন, ‘The eternal feminine holds us’ যেখানে তিনি একজন প্রেমস্পদা নারীকেই শুধু উদ্দেশ্য করছেন না, বরং পুরুষের সামনে নারী রূপিণী চিরন্তনী প্রেমিকা শক্তিকেও উপলব্ধি করছেন। যে নারী শুধু জায়া বা জননী রূপে বিরাজ করেন না বরং ঘরের বাইরে পুরুষকে মহত্তর বা স্থায়ী সৃষ্টির উন্মাদনায় মাতিয়ে  তুলতে সাহায্য করে। প্রেমিকার এই রূপকে শেক্সপিয়ার থেকে শোপেনহাওয়ার, রাশফুকো থেকে রবীন্দ্রনাথ, মার্কেজ থেকে মুরাকামির মতো মনীষীরা স্বীকার করেছেন নির্দ্বিধায়। 

ফ্রয়েডের মতে, ‘সচেতন মনের কাজ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও গতানুগতিক। এর অনুভব ও মনন নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তিগত বুদ্ধি, মস্তিষ্ক, ইন্দ্রিয় ও পরিপার্শ্বের দ্বারা। জগতের সঙ্গে লেনদেন করতে এই সচেতন মন সচেষ্ট থাকে যা চিনতে মানুষের বেগ পেতে হয় না।’ কিন্তু মনের গভীরে যার বাস, সেই অস্তিত্বের খোঁজে ছুটেছেন ফ্রয়েডও। আর এই অচেতন বা নিরজ্ঞান মনের অস্তিত্বের খোঁজ শুধু ঊনবিংশ শতকের বিজ্ঞানীরা নন কবি-লেখকরা খুঁজেছেন। ওই একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে 

কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।”

ভালোবাসা কী, তার বিশালতা বা ব্যাপ্তি কী, কী তার যাতনা, বেদনা সে কথা হয়তো স্বয়ং কবি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন কখনো কখনো। তাই তো বলেছেন, ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়!’ শেষে একথা স্বীকার করতেই হয় আমাদের সচেতন মনই সবটা নয়। বরং তার ভেতরের ভাব রসই আমাদের আবেগ ও প্রেমের দায়। তাই তো একটা সম্পর্ক কোনো কারণে ভেঙে গেলে, আরেকটা নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবেগগত ও ইন্দ্রিয়গত আনন্দের স্মৃতিকে তো খুন করা যায় না, বরং তাকে স্মরণের নিম্নতর স্তরে সরিয়ে রাখা যায়। বরং সচেতনে যে প্রেম ফিরে এলো তার একটা দৈহিক আশ্রয় চাই।

কবি নজরুলের ভাষায় বলতে হয়,

“প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন/তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।/মদ সত্য,  পাত্র সত্য নয়,/যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়।/প্রেম এক প্রেমিকা সে বহু/বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম/সে শরাব লোহু।”

নজরুলের এই কয়টি পঙ্ক্তি ক্যাসানোভা ও ডন জুয়ানের মনোবৃত্তির প্রতিধ্বনি নয়, বরং লক্ষ লক্ষ আন্তরিক প্রেম সাধকের অজ্ঞাত অন্তর্মথিত বাসনার প্রতিবিম্ব।

তাহলে প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞানের সর্বোন্নত পর্যায়ে এসে প্রেম ভালোবাসার সেই চিরন্তন আবেদন কি হারিয়ে গেছে? বরং আরও বিস্তৃত পরিসরে এখন তার অবস্থান। এখানে প্রেম শুধু অনুভ‚তিতে নয়, আছে বাণিজ্যের অনুষঙ্গ হিসেবেও। তাই তো সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমের জন্য উৎসর্গকৃত জীবন নিয়ে ভালোবাসার বাণিজ্যিক প্রসারে ব্র্যান্ড আইটেম হয়ে বসে আছেন। প্রযুক্তি ও বাণিজ্য প্রেমকে আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক পরিসরে হাজির করেছে। ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে অফারের পর অফার এসে হাজির হচ্ছে। বাণিজ্যের এই ডামাডোলে পড়ে প্রেম কতটা আছে সেটা বিষয় না, প্রেমের মরা যে জলে ডুবে নেই সেটাই আসল বিষয়। 

কথাসাহিত্যিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫