ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-শ্রীলংকা : একটি পচা শামুকনামা

যে ধামাকা গেলো তার কোনো তুলনা হয় না। ফাইনালের কথা বাদ দিলাম। ওটা তামাশা, খেলা নয়। ৫০ রানে আউট মানেই গুনতির মধ্যে পড়ে না। আশা করি এর পরও আইএমএফ ওদের টাকা ধার দেবে। তবে আমি বলছি- বাংলাদেশের হাতে ইন্ডিয়ার হার। বাংলাদেশের মতো টিম, যে ইদানিং বেশ লেদু মারকা খেলছে, আফগানিস্তানকেও ঠিকমতো হারাতে পারে না, শ্রীলংকার ধারে কাছে নেই, পাকিস্তানের কাছে কীভাবে খেলবে তার হিসাব নেই, সে টিম কিনা বেস্ট টিম ইন্ডিয়াকে হারিয়ে দিল। এটা কোনো কথা হলো? কিন্তু তা-ই ঘটে আর তার পর যে ধামাকা শুরু হয় তার তুলনা  নেই। খেলার চেয়ে বড় তা-ব। আমরা করলে তো হতো, আমরা তো করবই। হাইল্লারা কোরবানির মাংস পেলে এরকম লাফায় খুশিতে; কিন্তু যেভাবে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানি মিডিয়া এটা নিয়ে মাতল তার তুলনা হয় না। এসবের মূলে খেলা না অন্য কিছু? 

দুই

আসলে খেলা যুদ্ধের নিরাপদ সংস্করণ। অতএব এটা ভালোবাসা বৃদ্ধির প্রকল্প নয়, শত্রু ঘায়েলের। আর সেটা যখন দেশভিত্তিক হয় তখন তো আরও বেশি করে ঘটবে বিষয়টা। বাংলাদেশ এশিয়া কাপে ১২ বছর পর হারাল ইন্ডিয়াকে- এটা ক্রিকেট দুনিয়ার একটা ঘটনা কেবল নয়, এটা পচা শামুকের ওপর পা দিয়ে পা কাটার দুনিয়াতেও। এতসব কিছু এসেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। আর কই যাবে? এ দেখেছে ওরটা, আর একজনেরটা- এভাবেই কনটেন্ট ঘুরেছে কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা দুনিয়ায়। যেখানে ক্রিকেট দেখে সেটা ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ যেই হোক; যেখানে থাকুক। মানে সারা দুনিয়া। আর এসবের মধ্যে জাতীয়, দেশীয়, রাষ্ট্রীয় পলিটিক্স ‘হ্যালো’ বলে ঢুকে পড়ল বোঝা যায়।

তিন

এশিয়া কাপ যখন শুরু হয় তখন শুরু হয় ‘হলিটিক্স’ আমাদের প্রিয়তম বিষয়। আমরা দেশের স্পোর্টস দুনিয়া সারাক্ষণ দেখি। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার হচ্ছেন পাপন, কারণ তার নাম সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়। আর যেহেতু হারি নিয়মিত, তাই তার নামটা বেশ জনউচ্চারিত বলা যায়। তিনি করেন সরকারি দল। অতএব বিরোধীরা তো আছেই, সরকারিরাও তাকে ভালোবাসতে চায় না। বেচারা! এই সুযোগে প্লেয়ারদের চেয়ে তার প্রতি মনোযোগ বেশি সবার; কিন্তু এর সঙ্গে আছে জাতীয় পলিটিক্স। মানে কিনা ইতিহাসের পলিটিক্স। আপনি বাংলাদেশি তো বুঝলাম, আমরা সবাই তাই; কিন্তু আসলে ইন্ডিয়ান না পাকিস্তানি?

চার

নিরিখ যদি ১৯৭১ হয়, তা হলে ইন্ডিয়া সমর্থন তো লজিক্যাল তাই না? মানে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ইত্যাদি; কিন্তু ফেসবুকে একবার খুঁজে দেখুন, বুঝবেন কী অবস্থা। মানে ইন্ডিয়াকে সমর্থন করা আর শত্রুকে সমর্থন করা একই চিজ অনেকের কাছে। পাকিস্তান তো আমাদের জীবনে নেই, বইতে থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু মোদি তো আমাদের নিত্যসঙ্গী। তার কারণেই তো এতসব হচ্ছে, তার জন্যই তো একদল ক্ষমতায়, অন্যদল ক্ষমতায় আসতে পারছে না; কিন্তু তথাকথিত সুবিধাবাদী দলও ইন্ডিয়াবিরোধী অন্তত খেলার ক্ষেত্রে। এদিকে পাকিস্তান এই কারণে ফ্রিতে কিছু সমর্থন পায়। আর কেউ যদি একটু মুসলমান-ধার্মিক হয়, তবে তো ‘নাউজুবিল্লাহ’, ‘নাউজুবিল্লাহ’, হিন্দু ইন্ডিয়ার সমর্থক কেমনে হয়? কেউ কি ভেবেছিল ক্রিকেটে দল সমর্থন করা এত জটিলভাবে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়?

পাঁচ 

আমরা হারালাম ইন্ডিয়াকে বড় দল হিসেবে; কিন্তু আমাদের ‘পচা শামুক’ বলে আনন্দবাজার বুঝিয়ে দিল আমরা কোন অবস্থানে আঞ্চলিক পলিটিক্সে। ক্রিকেট দুনিয়ায় আমাদের অবস্থানের দিকে আঙুল তুলে জানাল। ‘পচা শামুকে পা কাটা’ মানে কোনো বীরের যুদ্ধে জয়; কিন্তু পিচ্চি সোলজারের হাতে একটু আহত হওয়া। কাপ জিতে তো তা-ই দেখাল ইন্ডিয়া। নো বিগ ডিল। আসলে আমরা চাইছিলাম ফ্রেস শামুক হতে বা কম করে আমাদের কুঁচো মাছ বলুক, এর বেশি কিছু নয়; কিন্তু একবার ভাবা যায়-কলকাতার বাবুদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের কী চেহারা পচা শামুক বাদে? ওদের কাছে আমরা সমকক্ষ নই, আমরা হলাম একটু নতুন টাকাওয়ালা, রুচিহীন, শপিংপাগল পাবলিক- যাদের অনেকে ইন্ডিয়ায় লুকিয়ে মাইগ্রান্ট লেবার হয়। যাদের দেশে না আছে বনেদিয়ানা, না আছে কালচার, না রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ রায়। এটা অনেকেই ভাবে এবং এটাই ঠিক। একটু চেতবে না? আপনি সারাদিন ‘কলকাতা কলকাতা’ করেন, ‘তোমরা বাঙালি, আমরা বাঙালি’ করেন আর তার পর খেলায় হারান, যদিও ১২ বছর পর। ভুলে যান কেন আপনি বাঙালি; কিন্তু ওরা ইন্ডিয়ান। কোনো কথা হলো? পচা শামুক তো একটা কমপ্লিমেন্ট বলা যায়, আরও কিছু বলেনি, কপাল ভালো। আমরা কষ্ট পেয়েছি কারণ ভেবেছি যে, আমরা যেমন নিজেদের প্রথমে বাঙালি ভাবি, তারপর বাংলাদেশি; ওরাও তাই। সরি দাদা, ওরা না, তাই ওরা খুশি হয়নি আমাদের জয়ে। আমরা কষ্ট পেয়েছি।

ছয়

তা হলে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান একে অন্যকে মারতে চায় কেন? উত্তরটা সহজ। ওরা দুজনেই রাজন্যগোষ্ঠী। মগধের আদি সূত্র তারা, তাদের ঝগড়া আদি। অকৃত্রিম, সমানে সমানে। ঘৃণার দিক থেকে, ওপর তলার, শামুক-ঝিনুকের নয়। তাই তারা একে অন্যের সবচেয়ে নিকটের। আমার মজা লাগত দেখতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মিটিংয়ে, কীভাবে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের মানুষ একে অন্যের সঙ্গে সবচেয়ে নিকটজন হিসেবে মিশত। কারণ তারা একে অন্যকে সমান ভাবে। এ জন্য ইন্ডিয়ার আর পাকিস্তানের শত্রুতা এত। আপনজনের সঙ্গে বিবাদ হয় সবচেয়ে তীব্র।

সাত

তা হলে আমরা কই যাই? সমর্থনের কী হবে? কচু হবে। দেশ একটাই। আমার দেশ বাংলাদেশ। অন্য কারও দেশ পাকিস্তান, কারও ইন্ডিয়া, কারও শ্রীলংকা (?)। তবে কিনা ক্রিকেট খেলায় এত দেশপ্রেম দেখানোর কিছু নেই, যদি না আপনার মনের ভেতর কিছু ঝামেলা থাকে। মানে- এটা কি বাঙ্গুদের জনপ্রিয় কর্মকাণ্ড পরকীয়া দুশ্চিন্তা প্রসূত? এটাই কি ক্রিকেট পরকীয়া? দেশপ্রেম যদি হতে পারে, পরকীয়া কিসিমের দেশপ্রেম নাকি এটা?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //