নড়বড়ে প্রত্যয়?

সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমের’ প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার ও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্লাস পরীক্ষা বর্জনে অচল হয়ে আছে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে প্রত্যয় স্কিম বাতিলে সরকারকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন শিক্ষকরা।

তবে এই দাবি পূরণে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

গত ১৩ মার্চ ২০২৪ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করবেন তারা পেনশনের ক্ষেত্রে প্রত্যয় স্কিমের অধীনে আসবেন। এ ছাড়া বিদ্যমান পেনশন পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত চাকরিরত, যাদের ন্যূনতম ১০ বছর চাকরি অবশিষ্ট আছে, তারা আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। শুরুতে প্রত্যয় স্কিমের ঘোষণা বেশ প্রত্যয়দীপ্ত মনে হলেও এখন তা নড়বড়ে বলেই অনুমিত হচ্ছে।

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, আগামী ১ জুলাইয়ের পর স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করা হবে। আরও বলা হয়েছে, প্রত্যয় স্কিম চালুর ফলে বিদ্যমান কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না। সরকারি ঘোষণার এই অংশটি আইন সঙ্গত ও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের দাবিগুলো এই আশ্বাসের নিরিখে বিবেচনার সুযোগ তাই আছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কম সংখ্যক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীনস্থ কর্মীদের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পেনশন স্কিম আছে। এ ধরনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা আনুতোষিক স্কিমের আওতাভুক্ত এবং তাদের জন্য সিপিএফ ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এ ব্যবস্থায় কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসর সুবিধা হিসেবে এককালীন আনুতোষিক পান; কিন্তু মাসিক পেনশন পান না। ফলে অবসরোত্তর-জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। তাই প্রত্যয় স্কিমের উদ্দেশ্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্ববহ এতে সন্দেহ নেই।

আন্দোলনকারী সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়া এই পেনশন স্কিম চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই অচল হয়ে আছে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।”

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিম-এটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের অংশ। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।”

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনের পর এককালীন গ্রাচুইটিসহ যে পেনশন সুবিধা পাওয়া যেত সেটি থেকে বঞ্চিত হবেন শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

বিদ্যমান পেনশন স্কিম অনুযায়ী, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে পেনশন পান সে জন্য মাসিক বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হয় না। নতুন স্কিমে কাটা হবে দশ শতাংশ।

শিক্ষকরা বলছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেউ অধ্যাপক পদ থেকে অবসরে গেলে গ্রাচুইটি পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, নতুন স্কিমে সেটি পাওয়া যাবে না। অবসরে গেলে অধ্যাপকরা এখন মাসিক পেনশন পান ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা, যার বিপরীতে তাদের প্রতি মাসের বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হয় না। প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে বেতন থেকে কেটে ও প্রতিষ্ঠানের টাকায় পেনশন পাওয়া যাবে প্রতি মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। তবে এককালীন কোনো টাকা পাবেন না পেনশনাররা। বর্তমানে প্রতিবছর পেনশনে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট হলেও প্রত্যয় স্কিমে সেটি বাড়বে না। 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছরে, কর্মকর্তারা ৬২ এবং কর্মচারীরা ৬০ বছরে অবসরে যান। প্রত্যয় স্কিমে বয়সের ক্ষেত্রটি সংশোধনযোগ্য। বিদ্যমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অবসরকালে অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পেলেও সেই ব্যবস্থা নেই নতুন পেনশন স্কিমে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ও বৈশাখী ভাতা কিংবা এলপিআর সুবিধা পান। কিন্তু নতুন পেনশন স্কিমে সেটি থাকবে কি না সেটি স্পষ্ট করা নেই।

সরকার প্রয়োজন মনে করলে তার অধীনস্থ যে কোনো প্রতিষ্ঠান আয়তনে ছোট করতে বা বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিদ্যমান নিয়মানুগ সুযোগ সুবিধা জনপ্রতিষ্ঠানে হ্রাস বা বন্ধ করা হয় না। কারণ এর ফলে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ে, যা ঐ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমাদের দেশে গত এক যুগে অনেক বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ফলে এ খাতে তুলনামূলক ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবেনা যে শিক্ষা খাতের এই ব্যয়

প্রকৃতপক্ষে মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ। তাই এই সকল প্রতিষ্ঠানে মেধাবীদের আকর্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে। পেনশন বা অবসর ভাতার ব্যবস্থা তারই একটি। 

আমাদের দেশে যৌথ বীমা ব্যবস্থা খুব দুর্বল। কোনো সরকারি কর্মচারী চাকরিরত অবস্থায় মারা গেলে তার পরিবার সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা বীমার অর্থ পান। আর জীবিতাবস্থায় অবসরে গেলে তিনি যৌথ বীমার কোনো অর্থ পান না। অথচ প্রতি মাসের বেতন থেকে কল্যাণ ও যৌথ বীমা খাতে অর্থ কর্তন করা হয়। এ যেন এক লক্ষ্যহীন অভিযাত্রা। বেসরকারি বীমা কোম্পানির সঙ্গে এ ব্যাপারে সমঝোতা হলে অবসরকালে বীমা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ প্রদান সম্ভব। যৌথ বীমা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হলে আপৎকালীন সুরক্ষার একটি ক্ষেত্র উন্মোচন করা সম্ভব। অবসরকালীন সময়ে অর্জিত ছুটি নগদায়নের অর্থ, গ্রাচুইটি বা পেনশনের পাশাপাশি উৎসব ভাতা প্রদানের বিদ্যমান ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা বা বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করা কঠিন কিছু নয়। এটি জটিল বিষয়ও নয়। আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই সরকার ও সুবিধা প্রার্থীর জন্য আলোচনার টেবিল যথোপযুক্ত স্থান। তার সদ্ব্যবহার দ্রুত করতে হবে।

একইভাবে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের বিষয়টি আন্দোলনের কারণে যুক্ত করা হলেও তার জন্য উপযুক্ত সময় হচ্ছে নতুন বেতন স্কেল প্রস্তুতিকাল। শিক্ষকরা শুধু মানুষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হবেন না, তাদের সিদ্ধান্তও প্রশংসাযোগ্য হতে হবে বলে আমরা মনে করি। এটি ভুললে চলবে না যে তাদের দাবি আদায়ের জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি সামগ্রিকভাবে দেশের ক্ষতি। এই ক্ষতি দীর্ঘায়িত হোক এমনটি কাম্য নয়। প্রত্যয় স্কিম যেন বোঝাপড়ার অভাবে মুখ থুবড়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ দোষত্রুটি বাদ দিয়ে প্রত্যয় স্কিমের উদ্যোগটি ভালো। প্রত্যয়কে প্রত্যয়ী করার জন্য ঘষেমেজে হলেও এতে শিক্ষকদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //