বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমাজপরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা: এগিয়ে তারুণ্য

বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীর শোকের ও অনন্য বীরত্বের এক গৌরবগাঁথা রচিত হলো ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে' ঘিরে। আপসহীনতা, নৈতিকতা ও ঐক্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ এবার বাংলাদেশ। এ হচ্ছে বাংলার তারুণ্যের এক চোখধাঁধানো উত্থান। ছয় বছর আগের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ পরিণতি পায় চলমান ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’। একটা অরাজনৈতিক আন্দোলন কী বিপুল পরিমাণে সমাজবদলের আন্দোলনের মূল্যবোধকে ধারণ করতে পারে, এ তারই উদাহরণ।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ মানুষের সহজাত। মানুষ মূলত সাম্যবাদী প্রাণী। অন্য কেউ নয়। আমাদের ইতিহাসে ব্রিটিশের বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে বাংলার মানুষ। আবার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল এখানকার মানুষ প্রথমে ভাষাকে কেন্দ্র করে, পরে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। যে দাবি অচিরেই স্বাধীনতার দাবিতে যৌক্তিক পরিণতি পায়। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা চেতনাজীবী হওয়া নয়; এ চেতনা বৈষম্যবিরোধী, সাম্যবাদী। চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সেজন্যই নৈতিকভাবে এত শক্তিশালী।যেকোনো সমাজে কোন এক গোষ্ঠির জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে অন্যদেরকে বঞ্চিত করার যে প্রথা তা ইতিহাসের শুরু থেকে। এই বৈষম্য প্রথম শুরু হয় শাসক ও শাসিত বা রাজা-রাণী ও জনগণের মধ্যে। তারপর তা বিকশিত হয়ে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, শ্রেণিসহ বিভিন্ন কিছুকে আশ্রয় করে। আর এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্যের কারণে সুবিধাভোগী গোষ্ঠি বৈষম্যমূলক অবস্থাটির চিরন্তনতা কামনা করে এবং জীবন বাজি রেখে তা টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করে। অন্যদিকে বৈষম্যের শিকার সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠিটি জীবন বাজি রেখে ঐ ব্যবস্থা ধ্বংস করে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে। যদি সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠিটি যুদ্ধে জয়লাভ করে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে একসময় এই নতুন অবস্থাটিও আবার আরেক বৈষম্যের সৃষ্টি করতে ও তার রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাসে বারবারই এমনটা হতে দেখা যায়।

রাশিয়ার দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবও তাই একদিন রুশ জনমনে ক্ষোভ তৈরি করলো। বিজয়ী মুসলিম লীগকেও একসময় ছুঁড়ে ফেললো বাংলার মানুষ। কোনো বিজয়ী শক্তিরই মনে করা উচিত নয় যে ইতিহাসে তাদের স্থানটি একেবারে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। অথচ আশ্চর্য হলো যে, সব বিজয়ীই তাই মনে করে। যা নতুন সংঘর্ষ ও রক্তপাতের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকেও অনেকেই বৈষম্যমূলক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ও করছে। কিন্তু বৈষম্য বৈষম্যই, কোনো কিছু দিয়েই যার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তবু সুবিধাভোগীরা সেই চেষ্টাই করে থাকে, হত্যার বিনিময়ে হলেও।

যেকোনো সমাজে দীর্ঘস্থায়ী কোটা ব্যবস্থার স্বাভাবিক ফল হলো একরকম অ্যাপারথেইড বা বর্ণবাদ সৃষ্টি। আসলে আ্যপারথেইডের সঠিক অর্থ হওয়া উচিত বৈষম্যবাদ। যেকোনো বর্ণবাদী রাষ্ট্রের শুরু কোনো একটি গোষ্ঠিকে এই বাড়তি সুবিধা দেওয়া থেকে। এজন্য দেশের মানুষকে দুইভাগে ভাগ করতে হয়, বিভিন্ন পরিচয়কে বিভাজনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হয়: যেমন ধর্ম, গোষ্ঠি, ভাষা, বর্ণ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সময় এরকম কোনো না কোনো বিভাজনের শিকার হয়েছে। অনেকদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ও না-করা নিয়ে তেমনি অদূরদর্শী বিভাজনের কৌশল চালু রয়েছে। এরকম বিভাজনকে অনেকের কাছেই শুরুতে প্রগতিবাদী মনে হতে পারে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে যে, এটি কতটা রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করতে পারে। মানুষকে ধর্ম, গোষ্ঠি, ভাষা, বর্ণ ইত্যাদি যেকোনো কিছুর ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী বিভাজনই মূলত ক্ষতিকারক হয় যদি তা রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হয়ে ওঠে তবু বিভাজনের ঐসব মাত্রা যতটা না ভিত্তিমূলক, তারচেয়ে অনেক কম ভিত্তিমূলক হলো স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরে মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার বিভাজন। এই বিভাজনটিকে আরোপ করা হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে, যা আরো অনাকাঙ্ক্ষিত ও সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় ভুল।

অ্যাপারথেইড শব্দটির আক্ষরিক অর্থ মানুষকে বিভাজন বা আলাদা করা। বিভাজনের সবচেয়ে সহজ ভিত্তি গায়ের রং, সেকারণে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড রাষ্ট্রটি ছিল বর্ণবাদী। কিন্তু বর্ণবাদী ছাড়াও নানারকম ভিত্তিতে অ্যাপারথেইড রাষ্ট্র হতে পারে। বাংলাদেশে সবক্ষেত্রে কোটায় কয়েক ধরনের শ্রেণিকে যে বাড়তি সুবিধা দেয়া হয় তা সমাজে বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। দেখা যাচ্ছে চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৩০ শতাংশসহ মোট ৫৬ শতাংশ চলে যায় বিভিন্ন কোটায়। বাকি ৪৪ শতাংশ যে মেধাবীরা পাবে সে সম্ভাবনাও কম। কারণ এই ৪৪ শতাংশের ওপরও আত্মীয় পরিচয়, সুপারিশ ইত্যাদির ভিত্তিতে ভাগ বসাতে পারে ঐ ছাপ্পান্নোর মধ্যে বড় অংশটিই। এরপর আছে প্রশ্নফাঁস, ঘুষের, বিয়ের ইত্যাদির বিনিময়ে আরো এক বড় শতাংশ। প্রকৃত মেধাবীদের জন্য আর কিছু থাকে না বললেই চলে।

যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ন্যায্য সমতাভিত্তিক বণ্টনকে নিশ্চিত করা, সেখানে রাষ্ট্রই বৈষম্যকে উসকে দিচ্ছে ও রক্ষা করছে। তার মানে এই নয় যে, কোনো কোটাই থাকতে পারবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরাও তা বলেনি। তারা কেবল একে অযৌক্তিক অবস্থা থেকে কমিয়ে একটি যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে আনার দাবি করেছে যা সুযোগসুবিধার ন্যায়সঙ্গত সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করতে পারে।

এরকম একটি যৌক্তিক দাবি হঠাৎ বিস্ফোরক হয়ে ও দেশব্যাপী আগুনের ফুলকির মত ছড়িয়ে পড়লো কেন? এ ব্যাপারে বিবিসি নিউজ বাংলার ১৭ জুলাইর প্রতিবেদনে (কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সরকার ‘প্রতিপক্ষ’ বানিয়েছে কেন?) লেখা হয়েছে: “আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, তাদের এই আন্দোলন পুরোপুরি ‘অরাজনৈতিক’ বিষয়। মেধার ভিত্তিতে যাতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হয় সেটিই তাদের চাওয়া। ... মিছিলে অংশ নেয়া একজন শিক্ষার্থী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের সম্মানের কোনো অভাব নেই। সরকার কেন আমাদের প্রতিপক্ষ বানাতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না। ... তাদের দাবি হচ্ছে, ‘রাজাকারের’ সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী তাদের সম্মানে ‘আঘাত’ করেছেন।”

কোটা রাখা প্রয়োজন দেশের পশ্চাৎপদ অংশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে যারা ইতিহাসের যাত্রাপথে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আর তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যতক্ষণ না সমতা অর্জিত হয়। কিন্তু পশ্চাৎপদ নয় তেমন বিশেষ একটি গোষ্ঠি বা শ্রেণির জন্য এই সুবিধা চিরন্তন করে তুললে যা হয় তা একটি অ্যাপারথেইড রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা- যে পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ করে অর্জিত একটি দেশের জন্য কখনই কাম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সন্তানদের জন্য ৩০% কোটা যত না মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিয়েছে তারচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে কেননা এক্ষেত্রে লক্ষ্য ছিল যেনতেনভাবে মুক্তিযুদ্ধের একটা সনদ সংগ্রহ। অতএব একে যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত পর্যায়ে কমিয়ে আনা দরকার ছিল আরও আগে। আবার একেবারে পশ্চাৎপদ কিছু মানুষ যারা অতীতে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাদের জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা রাখাও প্রয়োজন।

এই সাধারণ জ্ঞানটুকু থাকার জন্য কাউকে নিউটনের তৃতীয় সূত্র জানার বা রকেট সায়েন্স পড়ার দরকার হয় না। অথচ ক্ষমতাসীন বুড়া বুড়া রাজনীতিবিদরা এতকাল এই সামান্য কথাটা বুঝলও না কীভাবে? এই সামান্য কথাটা তাদের মাথায় ঢোকাতে শিশু-তরুণসহ অনেক মানুষকে রক্ত ও জীবন দিতে হলো কেন? তরুণরা স্বাপ্নিক- এটা হচ্ছে বয়সের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারা ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও। আর তাই ভবিষ্যৎ-নির্মাতাও।

লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh