আওয়ামী লীগ হয়ে গিয়েছিল হাসিনা লীগ

শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে সেনাবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারে ভারতের আগরতলায় চলে গেছেন এবং সেখান থেকে অন্য একটি বিমানে দিল্লির কাছে কোনো একটি বিমানবন্দরে নেমেছেন-এ পর্যন্ত খবর আজকে দেখলাম। শেখ হাসিনা একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তার আগে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর, সব মিলিয়ে ২০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। গত জানুয়ারিতে শেষ নির্বাচনটির পর এ পর্যন্ত ৬-৭ মাসের মতো ক্ষমতায় ছিলেন। 

কিন্তু শেখ হাসিনা যেভাবে পদত্যাগ করেছেন এটা কোনো স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না। বিদেশি পত্রিকাগুলো লিখেছে, শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। এই যে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া, অথবা দেশ থেকে দ্রুত বেরিয়ে চলে যাওয়া, এটা তো কোনো সম্মানের ব্যাপার নয়। জাতীয় রাজনীতিতে এটা একটা অসম্মানের ব্যাপার। শেখ হাসিনার শাসনকালে বিএনপি’র বহু লোককে একদম জেলা থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত  বহু লোককে বন্দি রেখেছে। অনেক অনেক মামলা দিয়েছে। অন্য কোনো দল উঠুক তিনি তা চাননি। ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ যে ভাষায় কথা বলে আসছেন, এই ভাষা আদৌ গণতান্ত্রিক সমাজের কোনো নেতার ভাষা হতে পারে না। সাধারণ ঝগড়াটে লোকেরা এক পক্ষ আরেক পক্ষকে যে ভাষায় কথা বলে, এটা অনেকটা সে রকম। 

একের পর এক তিনটি নির্বাচন হয়েছে, যার মধ্যে দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। একটা নির্বাচনে বিএনপি গিয়েছিল, যদিও সুবিধা করতে পারেনি। কারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যে উত্তেজনা, নিবেদিত কর্মী ও গুন্ডা বাহিনী দরকার তা বিএনপির ছিল না। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে আওয়ামী লীগের লোকেরা যে চাপ সৃষ্টি করত তার মোকাবিলা করাও তাদের অসম্ভব ছিল। এসব কারণে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারেনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দেখল যে খুব সহজেই নির্বাচনের ফল বের করা যায়। 

প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই ছিল না এখানে। একদিকে নির্বাচনবিহীন নির্বাচিত একটি সরকার, অন্যদিকে ইলেকশন কমিশন ছিল ব্যাপক বিতর্কিত। আর ভোটকেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য দলের লোকেরা যারা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছে তারাও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেনি। ভোটকেন্দ্রের নিয়ম হলো, যিনি প্রিজাইডিং অফিসার তার সঙ্গে প্রত্যেক প্রার্থীর প্রতিনিধি 

থাকবেন। ভোট গণনা শেষে ফলাফলে প্রতিনিধির স্বাক্ষর দিয়ে এটা চূড়ান্ত করতে হয়। কিন্তু এসব নির্বাচনে প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর না নিয়েই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের নামে এগুলো প্রহসন ছিল। রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর দায় প্রথমত আওয়ামী লীগের। দ্বিতীয়ত বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এবং কিছু কিছু বামপন্থি দল, তাদেরও অনেক ত্রুটি আছে । তারা নানাভাবে চেষ্টা করলে একটা কিছু উপায় করতে পারত। কিন্তু তিনটা নির্বাচন হয়ে গেল তারা কিছুই করতে পারেনি। 

এই পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে লোকে দায়ী করছে। আমি বলব যে বহুলাংশে দায়ী আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের লিডার শেখ হাসিনা। কিন্তু বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং আরও বামপন্থি যেসব দল তাদের যে কাজ করা দরকার ছিল, তারাও সে কাজ করেনি। রাজনীতিকে যেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া  দরকার তারা সে রকমটা নেয়নি। কোনোক্রমে ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করা, দখল করা রাজনীতিটা এ রকম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বেশি হয়েছে, আর হাসিনার সঙ্গে যে আওয়ামী লীগ-এটা তো আর সেই আওয়ামী লীগ নেই এটা হাসিনা লীগ হয়ে গিয়েছিল। দলের ভেতরে কোনো রকম গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। বিএনপির ভেতরেও তাই। তো এ রকম বাস্তবতায় এর মধ্যে হত্যা, গুম, অর্থ পাচার ইত্যাদি ঘটনা মানুষের মনে একটা বিক্ষোভ তৈরি করেছিল। মানুষের মনে রাজনীতির প্রতি একটা অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। 

তা ছাড়া আওয়ামী আমলে প্রচুর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে এবং দলের বাইরে অনেকগুলো মানুষের প্রাণ গেছে। আর ব্যাপকভাবে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। গত ১৪-১৫ বছর ধরে ক্রমাগত এসব করা হয়েছে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে থেকে একটু নড়াচড়া শুরু হয়েছে। আগে তো আওয়ামী লীগের নেতারা এসব নিয়ে কথাই বলেনি, ভাবটা এমন যে এগুলো তো হবেই। এ রকম ঘটনা যখন ক্রমাগত ঘটতে থাকে, সীমার বাইরে যেতে থাকে, তখন সরকারের উচিত ছিল এসব নিয়ন্ত্রণ করা। 

সেই অবস্থার মধ্যে কোটা পদ্ধতি সংশোধন, এটা এমন কোনো জটিল কঠিন পদ্ধতি ছিল না। কোটা পদ্ধতির সবটা নিয়ে তো আপত্তি ছিল না। ছাত্ররা আন্দোলন করেছে মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের পয়েন্টে। মুক্তিযোদ্ধা যারা ছিলেন তারা কোটার ভিত্তিতে চাকরিতে এসেছেন, তাদের ছেলেমেয়েদেরকে দেওয়া হয়েছে, নাতি-নাতনিদের দেওয়া হয়েছে এবং এটা অনন্তকাল চলবে-এই যে একটা অবস্থা এটা আমাদের দেশে হোক কিংবা অন্য দেশে, কোনো বিবেকবান লোক ঠিক মনে করবে না। 

আর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দেশটাকে ভাগ করেছে দুভাবে। এক বাক্যে বলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং আরেক ভাগকে বলেছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। এভাবে দেশবাসীকে ভাগ করা উচিত নয়। আওয়ামী লীগের ভেতরে যে গ্রুপিং ছিল সেটাই ছিল অগ্রগতির পথে আওয়ামী লীগের বাধা, এগুলোর মীমাংসা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব করতে পারেনি এবং শেখ হাসিনাও করতে পারেননি। ওপরের কারণগুলো ব্যতীত আরও দুটো কারণ-একটা হলো নির্বাচন সংক্রান্ত, ভোটারবিহীন নির্বাচনে অনির্বাচিত সরকারকে ইলেকশন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ঘোষণা করা এবং সমাজের ভেতরে  দ্রব্যমূল্য বাড়া, এগুলো হলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যা একসময় শেখ হাসিনাকে বাধ্য করেছে ক্ষমতা ছাড়তে। 

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা যায়, এখানে নানা মত ও পথের লোকেরা একত্রিত হয়েছে। বামপন্থি কিছু গ্রুপ আছে। যেমন-জুনায়েদ সাকি, এর মধ্যে ধর্মীয় গ্রুপ কিছু আছে, জামায়াতকেও রাখা হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা মোটামুটি সবাই বলে, কেউ গণতন্ত্রের জন্য ধর্মকে গুরুত্ব দেয় বেশি আবার কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করে। তিন চার রকম গোষ্ঠী পাওয়া যায় যারা একত্র হচ্ছে। 

এই যে অভ্যুত্থানটা হলো-এর নেতৃত্বে কে? এর নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন যে ছাত্ররা আরম্ভ করেছিল তারাই। আর অদৃশ্য নেতৃত্বে থাকতে পারে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সুশীল সমাজ সংগঠক। সুশীল সমাজ মানে পাইকারিভাবে, সেটা নয়। কিছু গ্রুপ আছে, দল আছে, যারা সুশীল সমাজ নামে পরিচিত। সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের ধারায় যে রাষ্ট্রচিন্তা এটা আমাদের দেশের অগ্রগতিকে সুস্থ ধারায় নিয়ে যায়নি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটা এই সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের কাছ থেকেই এসেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা দিয়ে আমাদের রাজনীতি ভেতর থেকে শেষ হয়ে গেছে। কেবল নির্বাচনের কথা বলে, জনসাধারণের জন্য আর কোনো ভালো কথা বলে না। ৮০ এবং নব্বইয়ের দশকেই সব বিরাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। বিএনপি এবং বামপন্থিদের ভুলের কারণে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের হাতে রাজনীতির উত্থান-পতনের শক্তি অনেকটা চলে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে কি কোনো দেশের রাজনীতি দাঁড়াতে পারে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় যে বিভিন্ন দল-গ্রুপ একত্রিত হয়েছে, তারা তাদের লোক চাইবে সরকারে, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনও চাইবে। তারপর বিএনপি যেহেতু এখন সবচেয়ে পরিচিত ও শক্তিশালী, তাদেরও কিছু দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেটা রাখতে হবে। তারপর কিছু ইসলামী দল আছে-ইসলামী দলগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, একটা হলো জামায়াতে ইসলামী, তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদের ছাড়া অন্য যারা আছে তারা খলিফায়ে রাশিদিনের মতো ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী শাসন করতে চায় না। তারা চায় তাদের দলের লোকেরা রাজত্ব করুক। তো এভাবে দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে দুটো ভাগ। এ রকম বাস্তবতা। তো এরকম বিপরীতধর্মী লোকদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করাই অনেক কঠিন ব্যাপার হবে। আর গঠন করার পর ঐক্য কতখানি থাকে তা সন্দেহ আছে। সরকার গঠন হবে একটা, তবে তার জন্য একটু সময় লাগতে পারে। সরকার করলেও যে সে সরকার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগিয়ে যাবে, দেশের মানুষ তাদেরকে পুরোপুরি সমর্থন দেওয়ার কোনো কারণ নাও থাকতে পারে।

আমার একটু সন্দেহ আছে যে কী হবে। রাজনীতিকে সুস্থ পথে আনতে হলে অনেক কিছু নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। সর্বদলীয় গণতন্ত্র হোক আমরা এটা চাই, তার জন্য যে প্রক্রিয়া আছে তা করতে হবে।

অনুলিখন : বখতিয়ার আবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //