রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রদের সাম্প্রতিক বিজয়,যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। ঘটনাটি জাতির ইতিহাসের একটা যুগান্তকারী ঘটনা। এই ঘটনা একটি পরিবর্তনমুখী উত্থানের প্রতিধ্বনি। এই বিজয় সামষ্টিক উদ্যোগের শক্তি এবং তারুণ্যের হার না-মানা চেতনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ছাত্র জনতার এই আবেগ, সংকল্প ও ন্যায়বিচারের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি আবারও প্রমাণ করেছে, ছাত্ররাই পরিবর্তনের জন্য অনিবার্য একটি শক্তি। ছাত্র আন্দোলনের সেই গর্বিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী, যারা বারবার ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল ১৯৭১ সালের বিশ্বমানচিত্রে নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল। এই যুগান্তকারী অর্জনকে ধরতে গিয়ে অবশ্যই জাতীয় চরিত্রের একটি মৌলিক সত্যকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ আবেগপ্রবণ, খুব দ্রুত অন্যায়- অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেসব মহৎ উদ্দেশ্য ও ইতিবাচক আকাঙ্ক্ষাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে রূপান্তরের জন্য যে টেকসই প্রচেষ্টা দরকার, অনেক সময় তার ঘাটতি দেখা যায়। এসব উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ছাত্র জনতাই মূল শক্তি।
কোটা সংস্কারকে প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্ররা সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রামে অসংখ্য নিরীহ তরুণপ্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছে।২০২৪- এর আন্দোলনের ধরন ১৯৯০-এর আন্দোলনের থেকে ভিন্ন। সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ছাত্রসংগঠনসহ সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠন মূল দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু এবারের আন্দোলনে রাজনৈতিক মতাদর্শ-নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল অথবা মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব থাকলে সেটা মূখ্য ছিলো না। মূখ্য বিষয়টি ছাত্র আন্দোলন। এর মধ্য দিয়ে বড় কিছু আশার যোগান দেয়। কারণ সেটা দেশের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা দিয়ে চালিত, কোন ব্যক্তিগত স্বার্থের লেশ মাত্র এখানে নেই।
ছাত্র আন্দোলন একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কতোটা জরুরি, আজ মানুৃষ তা উপলব্ধি করতে পারছে। ছাত্ররা, মোবাইল ফেসবুকের বাইরে কিছু পারে না, এটা যাদের ধারণা ছিলো তারা আজ দেখছে তারুণ্যের জয়, তারুণ্যের শক্তি। ১৯৯০-এর দশকে ছাত্ররা দুর্নীতিবাজ সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। সেই আন্দোলনের সময় যোগাযোগের যে কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল, এবারের কৌশল ছিল তার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ছাত্রদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিয়েছে সর্বত্র। একই সঙ্গে আন্দোলন সমন্বয়ের কাজে ব্যবহার করেছে।
২০২২ সালে দেশে
প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও আ.লীগ সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে
ব্যর্থ হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এতটাই ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে যে ২০২৪ সালের
বিশ্বগণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম অবস্থানে ছিল। মানবাধিকার
পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হয়েছে এবং সমাজের ভেতরে দুর্নীতি মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সম্ভবত সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি
ছিলো বেকারত্ব ও বাজারের প্রতি
নিয়ন্ত্রণহীনতা।
ছাত্র জনতার ভূমিকা প্রতিবাদের এ মুহূর্ত ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। তাই বলাই যায়, ছাত্ররাই আগামী দিনের বাংলাদেশের স্থপতি। মনে রাখতে হবে, ছাত্রদের দায়িত্ব কেবল শুরু হলো। নীতিবিষয়ক আলোচনায় আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। নিজেদের পছন্দের জায়গাগুলোয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, সেটা যেন পরিষ্কার একটা রূপকল্পের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয় সে বিষয়ে ভাবা আজ খুব জরুরি। রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ব্যবসা, প্রযুক্তি, শিল্প, সংস্কৃতি অথবা খেলাধুলা, সব ক্ষেত্রেই আমাদের জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দক্ষতা অর্জন করতে হবে ছাত্র সমাজকে।
ছাত্রদের এমন একটা বাংলাদেশের কথা
কল্পনা করতে হবে, যে বাংলাদেশ তার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে যাতে সাহসের সঙ্গে ভবিষ্যতের মোকাবিলা করা যায়। এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একটা দেশ নির্মাণ করতে হবে। যে দেশটি বিশ্বের সামনে গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাতিঘর হয়ে
উঠে। এবং বাংলাদেশকে একটি পরিপূর্ণ উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে নির্মাণ করার
বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। তৈরি পোশাক খাতের ওপর একক নির্ভরতা কাটিয়ে
অর্থনীতিকে বহুমুখী করার পথ থাকতে হবে। প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করে এবং বিভিন্ন
শিল্পে নতুন নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে হবে।
এখন দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপগুলো শক্তিশালী করা অপরিহার্য। সেখানে যেন একটি কঠোর জবাবদিহি ব্যবস্থা থাকে। এমন একটা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করতে হবে, যেখানে আইনের শাসন নিশ্চিত করা যায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন, সব নাগরিকের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। একটি স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল কেন্দ্র হওয়া উচিত। এর সঙ্গে সরকারের সর্বস্তরে জবাবদিহির সংস্কৃতি বিকাশে শক্তিশালী ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য যাতে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায় এবং সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণে অবশ্যই বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। ছাত্ররা কোটার বিপরীতে মেধা প্রতিষ্ঠার যে লড়াই করেছে, তার একটা নীতি হলো, সবার জন্য সমান ও ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করা। এত ত্যাগ আর আত্মদানের মধ্য দিয়ে যে অর্জন, তা বজায় রাখা ও সবার জন্য সব সুযোগ সমানভাবে নিশ্চিত করা আজকে একান্ত জরুরি।
বিশ্বে জ্ঞানভিত্তিক
অর্থনীতির যে বিকাশ ঘটছে, সেই চ্যালেঞ্জ মেটানোর জন্য আমাদের
শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। ১৯৯২
সালে দেশে প্রথম বেসরকারি খাতে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিস্তার লক্ষ্য করা গেছে।
দেশজুড়ে এখন ১০০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই
দ্রুত বিকাশ নিশ্চিত ভাবে উচ্চশিক্ষা বিকাশে বিপুল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু পরিমাণগত এই বৃদ্ধি
শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখলেই এর উত্তরণ
সম্ভব।
এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পাস করে বের হচ্ছেন, তাদের অনেকেই দক্ষতা ও জ্ঞানে আধুনিক চাকরিবাজারের উপযোগী নন। ২০২৪-২৫ সালে বৈশ্বিক একাডেমিক সূচকে বাংলাদেশের মাত্র পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখ করার মতো স্থানে ছিল। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশের ২ হাজার ২৫০টি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সূচকটি করা হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে উচ্চশিক্ষার প্রতিযোগিতায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্বল অবস্থানে রয়েছে ও উচ্চশিক্ষাখাতে উন্নতি করা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া তরুণদের জ্ঞান ও দক্ষতার সঙ্গে শিল্প খাতের চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুক্তিবাদী জ্ঞান,সমস্যা সমাধান ও ডিজিটাল সাক্ষরতার দিকে নিয়ে যেতে হবে।
আমাদের পাঠ্যক্রম অবশ্যই গতিশীল হতে হবে, যাতে করে অব্যাহতভাবে বিশ্বের সেরা অনুশীলনগুলো আত্মস্থ করা যায়। প্রযুক্তি এখন মানুষের বৌদ্ধিক জগতের ওপর অব্যাহতভাবে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে এবং একেকটা প্রযুক্তির গড় স্থায়িত্বকাল মাত্র তিন বছর। এ রকম বাস্তবতায় ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দক্ষ লোকবল তৈরি করতে হবে। নতুন নতুন উদ্ভাবন, উদ্যোগ এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিক দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের একুশশতকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের ধারাটি উল্টে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য এবং পদ্ধতিগত সমস্যা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।সবার জন্য মানসম্পন্ন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্য খাত সংস্কার এবং এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ছাত্র নেতৃত্ব এখন যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে অতীতে আপনাদের অনেক পূর্বসূরি যে ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। পরিবর্তনের এই উচ্ছ্বাস জাতি গঠনের শ্রমসাধ্য কাজের সঙ্গে মেলাতে হবে। দেশকে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করাতে হবে যাতে এই সোনার বাংলা বিশ্ববাসীর কাছে একটি মডেল হয়। তারুণ্যের শক্তি ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে একটি দেশ কোথায় যেতে পারে বিশ্ববাসী সেটা তাকিয়ে দেখবে এমন প্রত্যাশা সবার।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh