আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা যদি হয় ‘নাগরিক রাষ্ট্র’, তা হলে সেই রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’- এভাবে ভাগ করে ফেলার কোনোই অবকাশ নেই। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু হিসেবে বিভক্ত হয়ে আছে রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকরা বাঙালি, অবাঙালি, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- যা-ই হোক না কেন এবং তাদের নিজ নিজ জনসংখ্যা যা-ই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের কাছে তাদের পরিচয় শুধুই ‘নাগরিক’। রাষ্ট্রে তাদের অধিকার বাঙালিত্ব, মুসলমানত্ব, হিন্দুত্ব কিংবা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বা কোনো ভাষার পরিচয় দিয়ে নয়- শুধু নাগরিক পরিচয় দিয়ে। সে হিসাবে প্রকৃতঅর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কোনো জাতিরাষ্ট্রও নয়। সেটি শুধুই নাগরিক রাষ্ট্র। ধর্ম, ভাষা, নৃতত্ত্ব যার যার; কিন্তু নাগরিকত্ব সমভাবে সবার- এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যথার্থ অবস্থান।
যে রাষ্ট্র তার নগরিকদের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু চিহ্নিত করে বহু খণ্ডে ভাগ করে ফেলে, সে রাষ্ট্র কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বা নাগরিক রাষ্ট্র নয়। সে হিসাবে অন্যান্য শর্ত বাদ দিয়েও, অন্তত এক্ষেত্রে গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ কখনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। তা ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র বা সংবিধানে সেই রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে যদি সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, তা হলে সেই সংবিধান কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান নয়। রাষ্ট্রে নাগরিকদের ধর্মীয়, ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় থাকতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্র কাউকে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে না। গণতান্ত্রিক বা নাগরিক রাষ্ট্র বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি থাকার কারণেই বাংলাদেশে অন্যান্য সংকটের পাশাপাশি জনবিভাজনমূলক সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সংকট তৈরি হয়েছে এবং এই সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এমনকি সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সংকটকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পর্যন্ত হুমকির মধ্যে পড়েছে।
দুই
ধর্ম, ভাষা ও নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নাগরিক জনগোষ্ঠীকে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু হিসেবে বিভক্ত করা একেবারেই অনৈতিক, অমানবিক এবং মধ্যযুগীয়। এই অনৈতিকতা ও অমানবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায় অন্য আরেকভাবে। খেয়াল করুন, সংকটটি কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগুরুদের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া সংকট; কিন্তু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সরকার এটাকে শুধু বলে সংখ্যালঘু সংকট। সংখ্যালঘুরা তো কোনো সংকট সৃষ্টি করে না। সংকট তৈরি করে সংখ্যাগুরুরা। সংখ্যাগুরুরাই সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি দখল করে, জমি দখল করে, মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা ভাঙচুর করে। এ জন্যই এটা সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে সৃষ্ট সংকট। এটা একটি তৈরি সংকট। অর্থাৎ নাগরিক জনগোষ্ঠীকে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু হিসেবে বিভক্ত করাই হচ্ছে মূল সংকট। দাবি করা হয়, সংবিধানে তো সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো বিভাজন করে সমতার কথা বলা।
তিন
ধর্ম, ভাষা ও নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের এক অংশকে বিভিন্ন খণ্ডে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়- যেহেতু তারা সংখ্যালঘু, তাই তারা দুর্বল, অসহায়। প্রকাশ পায়- সংখ্যালঘুরা, সংখ্যাগুরুদের সমান নয়। তাই তারা (সংখ্যালঘুরা) সংখ্যাগুরুদের করুণার পাত্র। একটি রাষ্ট্রের বিপুল জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু বানিয়ে, তাদেরকে যুগের পর যুগ দুর্বল, অসহায় ও করুণার পাত্র জারি রাখা একটি বড় রাষ্ট্রীয় অপরাধ এবং এ অপরাধটি করে স্বয়ং রাষ্ট্র ও তার সংবিধান।
বৈষম্যমূলক সমাজে ‘দুর্বল’ ও ‘অসহায়’ সংখ্যালঘুরা শুধু করুণার পাত্রই হয় না, তারা একতরফা নির্যাতন ও নিপীড়নেরও শিকার হয়। ফলে সমাজে গুরুতর সংকট তৈরি হয়। রাষ্ট্র এই সংকট মোকাবিলা করে পুলিশ-র্যাব দিয়ে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা নানা কায়দা-কৌশলে এই সংকট জিইয়ে রেখে, সংখ্যালঘুদের পুঁজি করে নিজেদের দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ও আরও নানাবিধ স্বার্থসিদ্ধির মওকা পায়। নৈতিক, মানবিক ও রাজনৈতিক- সব দিক দিয়েই এটি একটি গুরুতর অপরাধ। এজন্য রাষ্ট্রের সংবিধানসহ সব কার্যক্রম থেকে এই জনবিভাজনমূলক ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ দুটি চিরতরে মুছে ফেলতে হবে।
আজকের ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে অঙ্গীকার তৈরি হয়েছে, সেটি রাষ্ট্রযন্ত্র ও সংবিধানের জোড়াতালির ‘মেরামত’ নয়। সে অঙ্গীকার রাষ্ট্র ও সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার পূরণ না হলে, আখেরে যেটি হবে, সেটি হলো- যেই লাউ, সেই কদু।
পুনশ্চ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই- আসন্ন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে, রাষ্ট্রের দ্বারা তৈরি ‘পাপ’ কথিত ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘুদের’ অনুষ্ঠানে যে কোনো অঘটন ঘটার শতভাগ শঙ্কা আছে। এই অঘটন অন্তর্বর্তী সরকার অথবা দেশে বর্তমানে সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দল বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের দ্বারা ঘটবে না- এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেটি ঘটানোর চেষ্টা করবে পতিত স্বৈরাচারের দেশি-বিদেশি দোসররা, নানা ষড়যন্ত্রমূলক উসকানির মাধ্যমে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকার, সব দল ও সংগঠন এবং হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান- সবাই সম্মিলিতভাবে সতর্ক থাকতে হবে এবং তা প্রতিহত করতে হবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh