বাংলাদেশে স্বৈরাচার বারবার ফিরে আসে কেন- এ প্রশ্ন ওঠে বাস্তব কারণেই। সদ্যপতিত স্বৈরাচারের আগেও দীর্ঘ ৩৫ বছর দেশ শাসন হয়েছে, বিভিন্ন মাত্রায় স্বৈরাচারের মাধ্যমেই― কখনও উর্দিপরা সামরিক শাসনের মাধ্যমে, কখনো রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে। এ জন্য বলা যায়- জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ একটি স্বৈরাচার-শাসিত দেশ।
যেমন সুনির্দিষ্টভাবে বললে― গণতন্ত্রহীনতা, বাকস্বাধীনতাহীনতা, গণনিপীড়নমূলক আইন, ক্ষমতা কুক্ষীগতকরণ, প্রহসনের নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দলবাজি, ক্যাডারবাজি, ডান্ডাবাজি, বিচারবর্হিভূত হত্যা, গুম, ধর্ষণ, রিলিফ চুরি, পুকুর চুরি, অর্থসম্পদ লুটপাট, সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি-জমি দখল, বিদেশে অর্থপাচার, বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় এবং চরম সামাজিক অবক্ষয়। এগুলো যদি স্বৈরশাসনের লক্ষণ হয়, তা হলে ৫৩ বছরে কার বা কাদের শাসনামলে কমবেশি স্বৈরাচার ছিল না- এই অমোঘ প্রশ্নটি ওঠেই এবং প্রশ্ন সবসময় উঠেছেও। যার প্রতিক্রিয়ায় জনগণের আন্দোলন-লড়াই-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে এক স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে; তার পর আরেক স্বৈরাচারের উত্থান ঘটেছে। স্বৈরাচার বারবার ফিরে এসেছে এভাবেই।
তবে বিগত সাড়ে পনেরো বছরের একনায়ক শেখ হাসিনার স্বৈরাচার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছিল। দেশ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছিল। এরকম চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দেশে কোনো সচেতন দেশপ্রেমিক, আদর্শিক ও সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে না পারার কারণে দেশব্যাপী এমন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল এই ফ্যাসিবাদের পতন হয়তো অসম্ভব।
কিন্তু অবশেষে অবিশ্বাস্য এবং নজিরবিহীনভাবে দেশের ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান এবং প্রায় এক হাজার ছাত্র-যুবা ও শিশু-কিশোরের বুকের রক্ত সেই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করে তুলল। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক তৈরি হলো। ইতিহাসের আলোকে এবং নানা বাস্তব কারণে অনেকেই দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে দাবি করছেন, এই ভয়ংকর স্বৈরাচারের পতনের ফলে দেশ প্রকৃত স্বাধীন হলো। যারা এটা দাবি করছেন, তাদের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক, আবার কোনো স্বৈরাচারের উত্থান না ঘটুক এবং তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে দ্রুতসময়ের মধ্যে একটি সচেতন, মতাদর্শিক সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটুক।
দুই.
এখন আমাদের বর্তমান লেখার শিরোনামের প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজে পাওয়া দরকার। স্বৈরাচার বারবার কেন ফিরে আসে, এককথায় এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর হলো― স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে, মূলত অতীতের ঔপনিবেশিক শাসনের জের, নয়া ঔপনিবেশিক আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে। আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও চরিত্র বোঝার জন্য কোনো জটিল তত্ত্বচর্চার প্রয়োজন পড়ে না। এটি বোঝার জন্য আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। সেই অভিজ্ঞতার কথাই এখন বলব।
ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশ কোনো আত্মনির্ভরশীল স্বাধীন পুঁজির দেশ নয়। এই দেশ পুরোপুরিভাবেই উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর গ্লোবাল পুঁজির ওপর নির্ভরশীল দেশ। বিদেশি পুঁজির ঋণ ছাড়া দেশ চলতে পারে না। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে আমরা দেখেছি- বিদেশি ঋণ ছাড়া দেশ চলতে পারে না। এখন পাঁচ দশক পরও দেখতে পাচ্ছি- আইএমএফ-এর ঋণ ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারি না। এর কারণ হলো- স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণ আনার পরও দেখা যাচ্ছে, আমাদের নিজস্ব জাতীয় অর্থনীতি তথা জাতীয় পুঁজির মহাসংকট। আমাদের নিজস্ব জাতীয় উৎপাদন মুখথুবড়ে পড়ছে। তা হলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ এনে আমাদের কী লাভ হলো? ঋণ নেওয়া হয় চিরকাল ঋণের বোঝা বহন করার জন্য নয় অবশ্যই। বরং রাষ্ট্রের জন্য ঋণ আনা হয় নিজেদের উৎপাদনমুখী জাতীয় পুঁজির বিকাশ এবং নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনে। তা হলে ৫৩ বছর পরও এই রাষ্ট্রকে পুরোপুরি বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় কেন? সেই কথাই এখন বলি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবে কী হয়? বিদেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যে ঋণ আনা হয়, তার সিংহভাগ খরচ হয় অনুৎপাদনশীল খাতে এবং ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো অপ্রয়োজনীয় ও উচ্চাবিলাসী ম্যাগা প্রকল্পের খাতে। তার ওপর আবার বেশি বেশি কমিশন খাওয়ার লোভে সেসব প্রকল্পের বাজেট অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করার ফলে ঋণের পরিমাণ দেড়-দুইগুণ বেড়ে যায়। যার বোঝা বহন করতে হয় জনগণকে।
দেশের অর্থনীতির এসব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় রাষ্ট্রের আমলাদের দ্বারা। আমাদের দেশে রাজনীতিকরা আমলাদের পরিচালনা করেন না, বরং উল্টো আমলারাই রাজনীতিকদের পরিচালনা করেন। ঔপনিবেশিক-নয়া ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির এই আমলারা হলেন পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী গ্লোবাল পুঁজির এজেন্ট এবং চরম দুর্নীতিপরায়ণ।
এর ফলে কী হয়? উন্নয়নের নামে সেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণের টাকার বিরাট অংশ, নানা ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে আমলা, মুৎসুদ্দি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের পকেটে চলে যায়। এই পকেটও কোনো গোপন পকেট নয়। দুর্নীতির টাকা চলে যায় ‘নিরাপদ’ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে টাকা বাতাসে ওড়ে, উড়তে উড়তে বিদেশে চলে যায়। বাদবাকি যা দেশে থেকে যায়, তা আমলা-বুর্জোয়াদের ভোগ ও বিলাস-বৈভবে নিঃশেষ হয়ে যায়। ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র ভাষায় এটারই নাম হলো- লুণ্ঠনজীবী অর্থনীতি।
এই অর্থনীতির প্রভাবের ফলে লুণ্ঠন চলে অন্যান্য ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রের এই লুণ্ঠনজীবী অর্থনীতির বিষ ছড়িয়ে পড়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই লুটেরা অর্থনীতি কলুষিত করে রাষ্ট্রের প্রশাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিদমন কমিশন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিসহ দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে। দেশে গণতন্ত্রের কথা বলে কখনো কখনো যে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন হয়, সেটিও হয় ‘বাতাসে ওড়া’ কোটি কোটি টাকার ‘ভোটাভুটি’র নির্বাচন।
এতক্ষণ উপরোক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করলাম পরিষ্কার করার জন্য যে, বাংলাদেশে গত ৫৩ বছর ধরে যারা পালাবদল করে দেশ শাসন করেছেন, তারা সবাই এই লুণ্ঠনজীবী অর্থনীতির আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারক-বাহক। বলাবাহুল্য, এবারকার নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের জোয়ারের ধাক্কায় এদের অনেকেই হয়ত ‘বিপ্লবী’ হয়ে গিয়ে থাকতে পারেন! সে যাই হোক, মোদ্দাকথা হলো- এই লুণ্ঠনজীবী অর্থনীতির আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যই তৈরি হয় গণতন্ত্রহীনতা, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ। এজন্য এই বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থাটি হলো- এক অন্ধকার গুহা।
তিন.
এখন বড় প্রশ্ন হলো- দেশকে এই অন্ধকার গুহা থেকে মুক্ত করে আলাকোজ্জ্বল পথে চালিত করার উপায় কী? এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভয়ংকর স্বৈরাচারের পতনের পর, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বাংলাদেশের, একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উত্তরণের এক ঐতিহাসিক সম্ভাবনা ও সুযোগ আজ তৈরি হয়েছে। এবারের গণঅভ্যুত্থানে, বিশেষ করে ছাত্রদের অবিশ্বাস্য রকমের নির্ণায়ক ভূমিকা প্রমাণ করল, তরুণ ছাত্র-যুবারা দেশের শুধু ভবিষ্যতের কান্ডারি নয়, তারা বর্তমানেরও কান্ডারি। সেই প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে ছাত্র-যুবারা কতোটা পিছিয়ে রয়েছে- এই প্রশ্ন ও বিতর্ক তোলার আগেই এখন যে জরুরি বাস্তবতা এবং ঐতিহাসিক অঙ্গীকার তৈরি হয়েছে সেটি হলো- দেশের তরুণ ছাত্র-যুবা এবং সব গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলনে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। গণঅভ্যুত্থান ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের আর কোনো বিকল্প নেই।
সবশেষে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বোঝাবুঝির কিছু ইশারা-ইঙ্গিত এখানে তুলে রাখতে চাই। জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থাটি হতে হবে আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পরিবর্তে দেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের; নির্বাচনী সংসদে প্রতিনিধিত্বসহ রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অবশ্যই সেটি কোনো ক্ষমতা ও শাসনের রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে না; সেটি হবে সেবামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ‘ক্ষমতা’ ও ‘শাসন’ কথাটা রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (সংবিধান) ও সব প্রতিষ্ঠান থেকে মুছে ফেলতে হবে। এমনকি মুছে ফেলতে হবে আমাদের অন্তর থেকেও। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’- এরকম হবে না। সেটি হবে- দুষ্টের শোধন এবং সবার জন্য সমান সেবার রাষ্ট্রব্যবস্থা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh