ভারত কি আরেকটি যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক পূর্বাপর ঘটনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর তথ্য, যা এতদিন চাপা পড়েছিল, সেগুলো আমরা আজ পাচ্ছি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে।

ভারতীয় গবেষক শ্রীনাথ রাঘবনের লেখা ‘বাংলাদেশ সৃষ্টির  বৈশ্বিক ইতিহাস’ গ্রন্থ পাঠ করে, একাত্তরের ২৫ মার্চে ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়- ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ববাংলার ওপর সর্বাত্মক হামলার ১০ দিন আগে শেখ মুজিবুর রহমান জানতে পারেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী আকাশপথে পূর্ব পাকিস্তানে আড়াই ডিভিশন সেনা পাঠাচ্ছে। সেই সঙ্গে তিনি জানতে পারেন যে, ঠিক ওই মুহূর্তে ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে (৬৫-এর যুদ্ধের পর থেকে মোতায়েন রাখা) তার সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ দুটি ঘটনা শেখ মুজিবকে বিচলিত করে তোলে। শেখ মুজিব মনে করেন, ওই সময়কার গুরুতর সংকট মুহূর্তে ভারত সরকার যদি পাকিস্তান সীমান্ত থেকে তার সেনা প্রত্যাহার না করে এবং সীমানা লঙ্ঘনের অভিযোগে পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখী পাকিস্তানি সেনা, জাহাজ ও বিমানগুলোকে বাধা দেয় অথবা কোনো ধরনের হুমকি বা হুঁশিয়ারি প্রদান করে, তাহলে তা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মনোবল কাঁপিয়ে দেবে। (রাঘবন, পৃষ্ঠা : ৬৮-৬৯)

রাঘবনের বই থেকে আরো জানা যায়- ‘শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে, জরুরি ভিত্তিতে উপরোক্ত দুটি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ, বিশেষ করে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার  না করার বিনীত অনুরোধ জানিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠান। লিখিত বার্তাটি তিনি তার দূত ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর মাধ্যমে পাঠান ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে। ‘কিন্তু ভারত সরকার তার কোনো জবাব দেয়নি এবং পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার স্থগিতও করেনি। তদুপরি ওই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখী পাকিস্তানি সেনা মার্চ করার বিরুদ্ধে নয়াদিল্লি কোনো বাধা বা হুঁশিয়ারি প্রদান তো দূরের কথা, কোনো কূটনৈতিক পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি। শেখ মুজিব তখন ভয়ংকর রকম ক্ষুব্ধ হন এবং পূর্ববাংলার ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলার আশঙ্কা করে ভীষণ রকমের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। (প্রাগুক্ত)

শ্রী রাঘবন তার গ্রন্থে উপরোক্ত বিবরণ তুলে ধরে আরো লিখেছেন-

শেখ মুজিবের এই অনুরোধ মেনে নিতে নয়াদিল্লির অনিচ্ছায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে। ভারত কেন নারাজ ছিল? গোড়াতেই হস্তক্ষেপ করলে কি পাল্লা বাঙালিদের পক্ষে ঝোঁকানো বেশি সম্ভব ও ফলপ্রসূ হতো না? স্বাধীন এক পূর্ববাংলা যে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে অতি কাঙ্ক্ষিত হতো, তা কি ভারতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বোধগম্য হয়নি? (প্রাগুক্ত)

এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, শ্রীনাথ রাঘবন যত প্রশ্নই তুলুন না কেন, নয়াদিল্লির বোধগম্যতা ছিল ভিন্ন রকম। নয়াদিল্লি চিন্তা করেছিল, ওই সময় ভারত যদি পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার না করত এবং পাকিস্তানিদের, পূর্ববাংলার ওপর সামরিক হামলা না করার হুঁশিয়ারি কিংবা কোনো ধরনের চাপ দিত, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্ত বা শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, শেখ মুজিবের ৬ দফা মেনে নিয়ে একটা আপসরফা করে ফেলত। অথবা ওই সময়ে পূর্র্ববাংলায় অবস্থিত মাত্র ১৩ হাজার অবাঙালি সেনাকে কুপোকাত করে ক্যান্টনমেন্ট দখলের মাধ্যমে বাঙালিরা নিজেরাই দেশ স্বাধীন করে ফেলত। 

কিন্তু নয়াদিল্লির কাছে এর কোনোটাই মনঃপূত ছিল না। মূলত ভারত সেদিন পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করে, পাকিস্তানি বাহিনীকে পূর্ববাংলায় হামলা করার সবুজ সংকেত দিয়েছিল। নয়াদিল্লি চাইছিল, পূর্ববাংলার ওপর সর্বাত্মক সামরিক হামলা ঘটুক এবং একটা অসম যুদ্ধ বাধুক। তখন ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে সুবিধা হবে। ইন্দিরাজির বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার তারিফ না করে পারা যায় না। একাত্তরের সেই ঘোলাপানিতে ‘মাছ শিকারে’র কাজটি ৫০ বছর পরও বহাল তবিয়তে চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া নয়াদিল্লি এ দেশের রাজনীতিতে তাদের তাঁবেদার ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীকে লালন করেছে।

দুই

তাহলে এ রকম একটা সন্দেহ করাই যায় (যে সন্দেহের কথা আমরা অনেক দিন ধরে ব্যক্ত করে আসছি) যে, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের ঘটনার সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। এদিকে ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের মূল হোতা যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার অতি কাছের কিছু জেনারেল, এটা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আবার ওই সময়গুলোতে ভারতের সঙ্গে ভুট্টোর কোনো না কোনোভাবে একটা গোপন যোগাযোগ ছিল, এ বিষয়েও তখন বাজারে মশহুর প্রচার ছিল।

সেই প্রেক্ষাপটে এ রকম একটি দাবি অবশ্যই করা যায় সেটি হলো, ২৫ মার্চের সর্বাত্মক হামলাটি ঘটেছিল ভুট্টো, কিছু জেনারেল ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা- এ তিনের নেপথ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এমনকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএরও তা অজানা থাকার কথা নয়। কারণ তখন থেকে মাত্র দুই বছর আগে (১৯৬৮ সালে) ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ গঠিত হয়েছিল সরাসরি সিআইএর তত্ত্বাবধানে (দেখুন : সতীশ কুমার : সিআইএ অ্যান্ড দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড, বিকাশ পাবলিশিং হাউস, দিল্লি)। 

বলা বাহুল্য, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের নেপথ্য ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্যেও একই ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বলে নিশ্চিত ধারণা করা যায়। ভারতের দুরভিসন্ধির ব্যাপারটাও তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে শেখ মুজিব, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে কী কারণে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন, সেটিও এখন পরিষ্কার বোঝা যায়।

তিন

অনেকে হয়তো বলবেন, যেভাবেই হোক আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। তাই এখন এসব পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? হ্যাঁ, আমরা স্বাধীন হয়েছি বটে। কিন্তু কিভাবে স্বাধীন হয়েছি, তার আধাআধি ইতিহাস নয়, পুরো ইতিহাস নতুন প্রজন্মের জানা জরুরি। ইতিহাসের নেপথ্যে যে আরো ইতিহাস আছে তাও জানা জরুরি। বিশেষ করে আজকের ২০২৪-এ জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পরাজয়কে, ভারত তার নিজের পরাজয় মনে করে- এমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে, মনে হয় তারা বাংলাদেশে আরেকটি যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এ জন্যই দেশের নতুন প্রজন্মের আজ ইতিহাসের নেপথ্য ইতিহাস জানা আরো বেশি জরুরি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা এবং রক্ষা করার জন্যই তা জানা জরুরি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh