বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের সুতা আলগা হলো কেন

একসময় বিএনপি ও জামায়াত শব্দ দুটি একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। বিশেষ করে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন ‘বিএনপি-জামায়াত’। অর্থাৎ তারা আলাদা করে বিএনপি বা জামায়াত বলতেন না। তাতে মনে হতো, বিএনপি ও জামায়াত বোধ হয় একটি দল! 

একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও জামায়াতের সখ্য ছিল। যদিও রাজনীতিতে সেই অধ্যায় নিয়ে আলোচনা কম। বরং নির্বাচন ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াতের ঐক্য এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব তৈরি হবে, সেটি হয়তো অনেকের কল্পনায়ই ছিল না। যদিও বিএনপির একটি বড় অংশই তাদের সঙ্গে জামায়াতের এই সখ্য ও ঐক্যের বিরোধী ছিলেন বরাবরই। এমনকি দলের কোনো কোনো সিনিয়র নেতাও জামায়াতের সঙ্গে জোট সমর্থন করতেন না বা এখনো করেন না। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে। কিন্তু তার পরও নানা বাস্তবতা ও বিবিধ কৌশলের কারণে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা দৃঢ় বন্ধন ছিল, যা গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ শিথিল হয়ে গেছে বলে নানা ঘটনায় দৃশ্যমান হচ্ছে। তাহলে এখন যে তাদের মধ্যে সম্পর্কের সুতাটা আলগা হয়ে গেল, তার কারণ কী? আদর্শিক নাকি সংস্কার, বিচার ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে চিন্তা ও অবস্থানের ফারাক?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুটি দল হিসেবে স্বীকৃত বিএনপি এবং গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। 

তৃতীয় শক্তিশালী দল হিসেবে একসময় এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিবেচনা করা হলেও নানা কারণে এটি এখন শক্তিহীন একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হয়। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম একটি বিরাট ফ্যাক্টর বলে জামায়াতকে অন্যতম বড় দল হিসেবে মনে করা হয়। তারা একসময় বিএনপির সঙ্গে সরকারেরও অংশ ছিল। কিন্তু ধর্মভিত্তিক দলের মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরেই একটি বৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের ভোট প্রাপ্তির দিক দিয়ে তার অবস্থান বেশ শক্ত। 

প্রথমত আদর্শিক, দ্বিতীয়ত ভোট ও আন্দোলনের মাঠে আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী দলকে মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবেই জামায়াতকে সঙ্গে রাখত বিএনপিÑএটি বেশ পুরোনো আলোচনা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পরে আওয়ামী লীগ যেহেতু ‘ব্যাকফুটে’, ফলে জামায়াত কি বিএনপিকে ছাড়াই এককভাবে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করছে বা আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে? বিএনপিও কি মনে করছে যে, এখন আর জামায়াতকে প্রয়োজন নেই?

১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। এই জোটের প্রধান দুটি দল ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায়ও আসে। এরপর আবার বিরোধী দলে যায়। চারদলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোট হয়। শেখ হাসিনার শাসনের শেষদিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়। বিশেষ করে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের একটি বড় অভিযোগ হলো, আওয়ামী লীগ সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর ফাঁসি দিতে থাকে, তখন বিএনপিকে পাশে পায়নি জামায়াত। এর পর থেকে বিএনপি সরকারবিরোধী যত আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক দিয়েছে, সেগুলোতে জামায়াত নৈতিক সমর্থন দিলেও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল না। আন্তর্জাতিক মহল থেকেও হয়তো বিএনপিকে জামায়াত থেকে আলাদা হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। বিশেষ করে যারা জামায়াতকে অগণতান্ত্রিক বা চরমপন্থি দল বলে বিবেচনা করে। 

জামায়াতকে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার’ বলে মনে করেন। রাজনীতি সচেতনরা মনে করেন, অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে এবং সেখানে জামায়াত এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিলেও খুব বেশি আসন পাবেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি যতটা আগ্রহী, জামায়াত ততটা নয়। 

আরেকটি অভিযোগ হলো, যেহেতু জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা, ফলে তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের একটি নতুন বয়ান তৈরি করতে চাচ্ছে, যা বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জামায়াত একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে বরং সাফাই গাইছে। ওই অনুষ্ঠানে জামায়াতবিরোধী বেশ কিছু প্ল্যাকার্ডও প্রদর্শন করা হয়। জামায়াতবিরোধী স্লোগানও দেওয়া হয়। 

অন্তর্বর্তী সরকার তাদের অগ্রাধিকারে রেখেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিচার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারÑযার মধ্যে রয়েছে সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, প্রশাসন ইত্যাদি এবং তারপরে নির্বাচন। কিন্তু বিএনপি মনে করে নির্বাচনই সংস্কারের প্রথম ধাপ এবং নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সংস্কার অর্থবহ হবে না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্বাচিত সংসদ ও সরকার ছাড়া কোনো সংস্কারের বৈধতা দিতে পারব না।’

কিন্তু বিএনপি যত দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে, জামায়াত নির্বাচনের ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নয়। উপরন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তরের সংবিধান ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের ‘অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলছে, বিএনপি তাতে সমর্থন দিচ্ছে না। কিন্তু এসব ইস্যুতে জামায়াত অনেকটা মৌন অথবা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে। এটিও এই দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়াচ্ছে বলে মনে করা হয়। 

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নয়, জামায়াতে ইসলামীর আমিরের এমন বক্তব্যও বিএনপি পছন্দ করেনি। উপরন্তু জামায়াতের আমির দাবি করেছেন, দেশে দেশপ্রেমিক শক্তি দুটি। ১. সেনাবাহিনী ও ২. জামায়াত। বিএনপি এই বক্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করেছে। 

বিএনপির সঙ্গে কি জামায়াতের দূরত্ব সত্যিই বাড়ছে? গত ১০ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাই। তারাও (জামায়াত) চায়। আমরা মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার কথা বলছি। তারাও বলছে। কিন্তু তারা যদি বলে যে, কেবল তারাই দেশপ্রেমিক, সেটা তো ঠিক নয়। এই ধরনের কথা বলা উচিত নয়।’ 

শোনা যাচ্ছে, জামায়াতের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে একটি বড় ঐক্য গঠনের চেষ্টা চলছে। এর মধ্য দিয়ে জামায়াত হয়তো বিএনপিকে ছাড়াই একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। কেননা ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে ধর্মীয় ইস্যুতে এমন সব ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে, যাতে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে যে আগামী দিনে হয়তো ছাত্র, নাগরিক কমিটি ও ইসলামিক দলগুলোর জোটের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার হবে। তাহলে বিএনপির অবস্থান কী হবে? এ রকম একটি চিন্তা অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও আছে বলে শোনা যায়। ফলে এটি নিয়েও বিএনপির চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। 

পরিশেষে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যে স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ভোট ও জোটের ঐক্য হয়েছিল, সেই বাস্তবতা এখন ভিন্ন। কারণ তাদের ‘কমন এনিমি’ আওয়ামী লীগ ‘ব্যাকফুটে’। ফলে দুটি দলই হয়তো চাইছে নিজেদের মতো করে চলতে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব বাড়বে নাকি আগের মতোই তারা জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে অথবা আলাদাভাবে নির্বাচন করেও তারা কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে কি না, তা এখনই বলা মুশকিল। কেননা আগামী এক-দুই মাসে দেশের রাজনীতিতে নানা ঘটনা ঘটবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh