পুলিশ সংস্কার কমিশন যেদিন (১৫ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিল, তার পরদিনই সাংবাদিক মুহিবুল্লাহ মুহিব ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন এ রকম- ‘দুই বন্ধুর ঝগড়া গড়াল থানা পুলিশে। মীমাংসা করতে আমিও গেলাম থানায়। আমি এবং দুজন পুলিশ অফিসারের মধ্যস্থতায় সমস্যার অবসান হলো। চলে আসার সময় এক পুলিশ ভাই বললেন, আপনারা মিলে গেলেন, এখন আমাদের কিছু খরচাপাতি দিয়ে যান। দুই বন্ধু দুই হাজার টাকা দিয়ে থানা ত্যাগ করলেন। যে থানায় এই ঘটনা, ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সেই থানা পুরোপুরি ভস্মীভূত হয় জনতার ক্ষোভের আগুনে। থানার কংক্রিটের দেওয়ালে এখনো দগদগে ক্ষত। জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত না শুকালেও আমরা ফিরেছি ঠিক আগের চেহারায়।’
এর দুই দিন পর ১৮ জানুয়ারি যমুনা টেলিভিশনের একটি খবরের শিরোনাম : ‘নাটোরে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে এসআই ক্লোজড।’ খবরে বলা হয়, নাটোর সদর থানার ভেতরে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে আসা এক সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক সেবাপ্রার্থী সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলামের সঙ্গে হাত মেলানোর ছলে ঘুষ দেন। পরে আমিনুল তা ড্রয়ারে রেখে দেন। অপর এক ভুক্তভোগী জানান, যারাই পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করেন, তাদের থেকে কৌশলে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা টাকা আদায় করেন। নাটোর সদর থানার ওসি সাংবাদিকদের জানান, অভিযুক্ত এসআইকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে।
এই দুটি ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা প্রতিদিনই এ রকম ঘটনা ঘটছে। তার মধ্যে দু-একটি নিয়ে গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হয়। যেসব ঘটনা নিয়ে কেউ অভিযোগ করছে না বা মুখ খুলছে না, সেসব আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট একটি সরকারের পতনের পর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কোথাও কি পরিবর্তনের কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে?
জুলাই অভ্যুত্থান এবং তার আগেও বছরের পর বছর ধরে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের যে এন্তার অভিযোগ ছিল, তাদের ভেতরে কি আদৌ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে? জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ যেমন নিহত হয়েছেন, তেমনি অনেক পুলিশও নিহত হয়েছেন। পুলিশের ওপর বছরের পর বছর ধরে মানুষের যে রাগ-ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছিল, এই ঘটনার পেছনে কি তার কোনো দায় নেই? পুলিশ কি এটা উপলব্ধি করতে পারছে যে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে তারা যদি সত্যিই জনবান্ধব হতে না পারে; জনগণের বন্ধু না হোক, অন্তত তারা যদি গণবিরোধী হওয়ার প্রবণতা থেকে বের হতে না পারে, তাহলে কী পরিণতি হবে?
এ রকম বাস্তবতায় গত ১৫ জানুয়ারি যে চারটি সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার হাতে তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে, পুলিশ সংস্কার কমিশন তার অন্যতম। পুলিশের বল প্রয়োগ, আটক-তল্লাশি-গ্রেপ্তার-জিজ্ঞাসাবাদ, মানবাধিকার, জবাবদিহি, জিডি-মামলা-ভেরিফিকেশন, আইন সংশোধন, দুর্নীতি প্রতিকার, প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর মোট ১১৩টি সুপারিশ করেছে কমিশন। এর মধ্যে কয়েকটি সুপারিশ এ রকম-
১. গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন।
২. আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া একটি আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ নির্মাণ।
৩. অভিযান পরিচালনার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইস থাকবে। তারা বাহিনীর পোশাক পরিহিত থাকবেন।
৪. রাতের বেলায় (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়) গৃহ তল্লাশির ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট/স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি/স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআর-বহির্ভূত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
৬. ভুয়া/গায়েবি মামলায় অনিবাসী/মৃত/নিরাপরাধ নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৭. অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা পরিহার করতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্য যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাউকে এ ধরনের মামলায় হয়রানি করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৮. বিচারপ্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
৯. আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
১০. জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়া যেতে পারে।
১১. চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা/শিক্ষা সনদপত্র/ট্রান্সক্রিপ্ট/মার্কশিট ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। এগুলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না।
দেখা যাচ্ছে প্রতিটি সুপারিশই যৌক্তিক, সময়োপযোগী এবং পুলিশের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ মামলায়ও আসামি ধরতে মধ্যরাতে বাড়িতে গিয়ে হানা দেওয়ার ঘটনা অহরহ। পুলিশ এ ধরনের ঘটনা ঘটায় মূলত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তার পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য। মধ্যরাতে ঘুমন্ত মানুষের দরজায় আঘাত করে বা চিৎকার করে তাকে তুলে থানায় নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা শুধু দাগী আসামি, সন্ত্রাসী, দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা খুনির মতো অপরাধীর ক্ষেত্রে ঘটতে পারে কিংবা যাকে কোনোভাবেই ধরা যাচ্ছিল না। কিন্তু সাধারণ মামলায় এমনকি ভুয়া মামলায়ও আসামি ধরতে মধ্যরাতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশের হানা দেওয়া যে বিরাট ট্রমা তৈরি করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এ ধরনের ঘটনার যে কী ভয়াবহ প্রভাব পড়ে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে ধারণা করাও কঠিন।
এ ধরনের ঘটনা এক দিনে বন্ধ হয়ে যাবে, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু পুলিশ যদি আজকেই একটি অফিশিয়াল নির্দেশনা জারি করে বলে দেয় যে চিহ্নিত সন্ত্রাসী তথা বড় অপরাধী ছাড়া কোনো সাধারণ মামলায় এমনকি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আটক ও গ্রেপ্তারেও মধ্যরাতে বাসায় গিয়ে হানা দেওয়া যাবে না; বাসা থেকে গ্রেপ্তার করতে হলে সকাল হওয়ার জন্য পুলিশকে অপেক্ষা করতে হবে, তাহলেও একটা বড় পরিবর্তন আসবে।
মামলায় অজ্ঞাত আসামি দিয়ে পুলিশ বছরের পর বছর ধরে যে গ্রেপ্তার ও আটক বাণিজ্য করে আসছে, তাতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। ৫ আগস্টের পরে যে অসংখ্য মামলা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই শত শত অজ্ঞাত আসামি। এসব আসামি ধরা কিংবা ধরার ভয় দেখিয়ে পুলিশ কী পরিমাণ বাণিজ্য করছে, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
বস্তুত পুলিশের সমস্যা এত বেশি যে, এক দিনে, এক মাসে বা এক বছরেও হয়তো এগুলো ঠিক করা যাবে না। কিন্তু পরিবর্তনের সূচনা যে হয়েছে এবং সরকার তো বটেই, পুলিশ নিজেও যে পরিবর্তন চায়, সেটি তাদেরই প্রমাণ করতে হবে। মুশকিল হলো, পুলিশের অপরাধ ও দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেলে তাদের শুধু বেতনের পয়সায় চলতে হবে। কিন্তু কিছু বতিক্রমী সৎ লোক বাদ দিলে বিরাট অংশেরই টার্গেট থাকে বিপুল ধনসম্পদের মালিক হওয়া। মানুষের এই লোভ তথা চাহিদার লাগাম টানা না গেলে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন। প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার করে কিছু সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু আখেরে মানসিকতার পরিবর্তন না হলে শুধু পুলিশিং দিয়ে পুলিশ ঠিক করা কঠিন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh