শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট কেন শিক্ষা ও গবেষণার কথা বলে না

একসময় শিক্ষা ছিল গুরু ও শিষ্যনির্ভর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান থাকতেন একজন প্রথিতযশা ব্যক্তি, যিনি তার শিক্ষা কর্মের মাধ্যমে উৎকর্ষ অর্জন করেন। সাধারণভাবে বলা যায়, বৌদ্ধদের প্যাগোডার প্রধান হিসেবে অধ্যক্ষ, হিন্দুদের আশ্রমের প্রধান হিসেবে গুরু বা প-িত, মুসলিমদের মাদরাসার প্রধান হিসেবে হেড মৌলবি এবং খ্রিস্টানদের গির্জার প্রধান ব্রাদার বা সিস্টাররা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতেন। এই বাংলায় শিক্ষার শুরু হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধর্মীয় উপাসনালয় প্যাগোডা থেকে। একই সময়ে হিন্দু ধর্মের গুরু বা প-িতদের হাত ধরে আশ্রম থেকে, খ্রিস্টান ধর্মের ব্রাদার এবং সিস্টারদের মাধ্যমে গির্জা থেকে এবং সবশেষে মুসলিমদের মাদরাসা থেকে। 

ব্রিটিশ ভারত রাজের সময়ে প্রথম ইংরেজি ভাষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়। পাশ্চাত্যের আদলে তৈরি করা হয় স্কুল এবং কেন্দ্রীয় পরীক্ষাব্যবস্থা। পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভারত রাজে চাকরি দেওয়া শুরু হয়। ফলাফলের প্রমাণস্বরূপ প্রবর্তন করা হয় ‘সনদ’ ব্যবস্থাপনা। সেই থেকে আমাদের দেশে সামাজিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক প্রসার শুরু, যা আজও চলমান। এখনো আমাদের দেশে প্রতি বছর নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্ম হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে অমরত্ব দেওয়া হয় চাকরিপ্রাপ্তিতে সনদ বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে। 

ব্রিটিশদের তৈরি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের নাম দেওয়া হয় স্কুলের ক্ষেত্রে ‘হেড মাস্টার’, কলেজের ক্ষেত্রে ‘অধ্যক্ষ’ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ‘আচার্য’। ব্রিটিশ রাজের শাসনের অবসান পরবর্তী সময়ে সব রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যা নব্বইয়ের দশকেও দৃশ্যমান ছিল। দুই হাজার সাল পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জনের উৎস হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে যায়। ফলে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকহারে তার নেতৃত্ব হারিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। 

২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে কম্পিউটারের অবাধ প্রচলনের ফলে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় (হাতের মুঠোয় ধরা যায় এমন একটা ২.৫ ইঞ্চি গুণ ৬ ইঞ্চি ছোট্ট একটা যন্ত্রের নাম মোবাইল ফোন)। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট, যা সব পৃথিবীর মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে আসে। এই জাদুর ছোঁয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও লেগেছে। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট আছে, যা সমাজের তথা বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠানের অবদান তুলে ধরে। এসব ওয়েবসাইটে আমরা কী দেখতে চাই? আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অর্জন দেখতে চাই। তাদের কাজের সামগ্রিক প্রতিফলন দেখতে চাই। আর কী দেখতে পাই? সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের বা পর্ষদ সদস্যদের পোর্টফোলিও, প্রতিদিনের কর্মকা- ইত্যাদি। ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষার ফলাফল, জাতীয় দিবস বা বিশেষ দিন উদযাপনের কিছু ছবি। এসব ছবিতে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা অবশ্যই থাকবেন। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপনা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। এক ভাগে থাকবে শিক্ষা উপকরণ, যেমন লেকচার কনটেন্টের ভিডিও। প্রতিদিন শিক্ষকরা ক্লাসে পড়াচ্ছেন। এক বছর সময়জুড়ে প্ল্যান করে সব লেকচার এবং ল্যাব ক্লাসের ভিডিও করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে আর্কাইভ করে রাখতে হবে। আর দ্বিতীয় ভাগে থাকবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাজের প্রতিফলন। এ ক্ষেত্রে আমাদের ঠিক করতে হবে কী কী ফলাফলকে আমরা আউটকাম হিসেবে নেব। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন লক্ষ্য ঠিক করে। এই লক্ষ্যগুলোকে সূচক আকারে ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা যেতে পারে। সূচকগুলো এমন হতে হবে, যেন তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে সমাজের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়।

প্রথম সূচক সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সূচকের গণনাপদ্ধতি স্কুল ও কলেজের জন্য সহজ, কারণ তা শিক্ষা বোর্ড থেকে করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর সহজেই করতে পারবে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কাছে সব শিক্ষার্থীর ফলাফলের তথ্য থাকে। এ ক্ষেত্রে পাস কোর্স, অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা গণনা করতে হবে। এই শিক্ষার্থীর সংখ্যা, নাম, রোল, রেজিস্ট্রেশন, যোগাযোগের ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য সনদ ও বিভাগ অনুযায়ী একটা এক্সেল ফাইলে সংরক্ষণ করতে হবে যার ভিত্তিতে ওয়েবসাইটে শুধু একটা পূর্ণ সংখ্যা দেখাবে। এই তথ্য একই সঙ্গে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ঠিক করতে কর্ম পরিকল্পনা তৈরি ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করা যাবে।

দ্বিতীয় সূচক মুদ্রিত বই, জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ এবং পেটেন্ট সংখ্যা। মান যাচাইয়ের সূচকস্বরূপ বইয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রণ সংখ্যা, জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ এর ক্ষেত্রে সাইটেশন সংখ্যা এবং পেটেন্টের ক্ষেত্রে এর বাজার মূল্য উল্লেখ করতে হবে। এসব তথ্যের প্রমাণ হিসেবে বইয়ের প্রথম দুই পাতা (কভার ও প্রকাশনা তথ্য), জার্নাল ও পেটেন্টের ক্ষেত্রে লেখকের গবেষণা প্রোফাইলের লিঙ্ক দিতে হবে।  

তৃতীয় সূচক শিক্ষা ও গবেষণায় খরচকৃত অর্থ। শিক্ষা ও গবেষণার খাতগুলোকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারলে এই অর্থ খরচ হবে টেকসই বিনিয়োগ। এর পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। প্রমাণ হিসেবে খাতওয়ারি খরচের হিসাব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা স্বাক্ষর করে সংরক্ষণ করতে হবে।   

চতুর্থ সূচক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়। সামাজিক প্রতিযোগিতায় যোগ্য শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে চাইলে সাধারণ মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে হবে না। আর একবার সাধারণ মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তকমা লেগে গেলে এর থেকে বের হওয়া কঠিন। তবে ধীরে ধীরে টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নত করা গেলে সুনাম ধরে রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা দরকার। শুধু শিক্ষার্থীদের ফি এবং অনুদাননির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজনমতো পরিচালনা করা যায় না। তবে সামাজিক আয়ের ক্ষেত্র ঠিক করতে হবে। এখন আয় করার নাম করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন এবং মাঠ ভাড়া দিয়ে দোকান, বাণিজ্যিক অফিস, ব্যাংক, বাজার, মেলা, বিপণিবিতান, নির্মাণসামগ্রী রাখাসহ বিভিন্নভাবে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।      

আয় এর সবচেয়ে ভালো উৎস হলো বৃত্তি। সমাজের অনেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে অনুদান দিতে চায়, কিন্তু আস্থা পায় না বলে দেয় না। এ ক্ষেত্রে বৃত্তি পরিচালনার মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষার্থীদের ফিস গ্রহণ করলে আস্থা তৈরি হবে। বৃত্তি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক গরিব, মেধাবী এবং বিশেষ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার খরচ দেওয়া যাবে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে যৌথ গবেষণা, পরামর্শ, গবেষণা প্রকল্প, বই বিক্রি, তথ্য বিক্রি, স্টার্ট আপ কম্পানি এবং শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজ আয়ের ভালো উৎস হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থাপনা শিক্ষাসংক্রান্ত কনফারেন্স, সেমিনার, বইমেলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কাজে ভাড়া দিয়ে আয় করা যায়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটকে একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের আয়না এবং সমাজের কাছে জানালার মতো কাজ করতে হবে। নিজেদের অর্জন যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনি সমাজের জন্যে শিক্ষা ও গবেষণায় ভূমিকা রাখতে হবে। প্রযুক্তির এই যুগে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃষ্টিতে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটকেই শিক্ষা প্রচারের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh