গান যখন প্রতিবাদের হিরণ্ময় হাতিয়ার

রাজ শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা সুরগুলো যখন গান হয়ে ওঠে তখন কেঁপে ওঠে শাসকের তখ্ত-তাউস। একটি সাধারণ গান হয়ে ওঠে প্রতিবাদের  হিরণ্ময় হাতিয়ার। এসব গানের মান বিচারের চেয়ে সময়ের প্রয়োজন মেটানোর বিষয়টি থাকে মুখ্য। গানের সুর যদি মানুষের ভেতরে প্রশ্ন তোলে, সেই সুরে সারা দিয়ে জনগণ যদি পথে নেমে আসে তাহলে সেই কর্তৃত্ববাদ যতই শক্তিশালী হোক তার গদি টলে যায় নিমেষে। পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি জনগণ কিভাবে কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ছুড়ে ফেলে দেয়। আর গান তাতে কতটা ভূমিকা পালন করে।

সংগীতের অমিত রসধারা মিশে আছে আমাদের রক্তে। গানের আছে এক সম্মোহনী শক্তি, যা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, আবেগে ভাসিয়ে দেয়, শিকড়কে চেনায়, তুলে ধরে জীবনের অর্থ। একইভাবে গানই খুঁজে দেয় মুক্তির পথ। সংগীত কীভাবে মুক্তিকামী মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধে গান হয়ে উঠেছিল লড়াইয়ের এক হিরণ্ময় হাতিয়ার। আজ অবধি গানের সেই অবস্থান একটুও বদলায়নি। আন্দোলন বেগবান করতে গানের বিকল্প নেই সেটা চল্লিশের দশকে গণনাট্য সংঘের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে প্রথম দেখা যায়। 

স্বাধীনতার পর পাঁচ দশক চলে গেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গান আবার আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে উঠে এসেছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একদিকে রাষ্ট্রশক্তির চলেছে লড়াই; অন্যদিকে চলেছে মিছিল, মিটিং ও গান। এই সংগ্রামে লাখো জনতা রাজপথে নেমে এসে কণ্ঠ মিলিয়েছে ছাত্রদের সঙ্গে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেভাবে উঠে আসে সময়ের গান, তেমন অনেক গানই আন্দোলনকে গতিশীল করেছে। ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী, নতুন গান, কবিতা, স্লোগান। আবার অনেক পুরোনো গানও আন্দোলনের প্রয়োজনে উঠে এসেছে সংগ্রামী ছাত্রদের কণ্ঠে। যেসব গানে জেগেছে বিদ্রোহের সুর, যা মানুষের মনে আঁচড় কাটার পাশাপাশি শোণিত ধারায় বইয়ে দিয়ে সংগ্রামের অগ্নিবারতা। 

পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ কিংবা বিপ্লবে কবিতা-গানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে যেসব কথামালা শিল্পীর কণ্ঠে গীত হতে থাকে, তার পেছনে বিশাল অবদান রাখেন গীতিকার কিংবা কবিরা। মুক্তিযুদ্ধের পর এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে বেশকিছু গান। তার মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মোহিনী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রিন্স মাহমুদ, হায়দার হোসেন, ইথুন বাবু, ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান প্রমুখদের লেখা গান আলোচিত হয়েছে। অফলাইন-অনলাইন এবং আন্দোলনের মাঠে এই গান উদ্দীপ্ত করেছে। সমবেত কণ্ঠে গেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটকে মিলিয়ন-বিলিয়ন ভিউ পেয়েছে গানের ভিডিওগুলো। তরুণ শিল্পী সেজানের গাওয়া ‘কথা ক’ গানটিও এখন আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে ফিরছে। ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের সাবেক তারকা গিটারিস্ট অনি হাসানের কম্পোজিশনে কাজী জোহাদ ইয়াদানীর গাওয়া ‘আমরা বীর’ গানও প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলতে শুরু করেছে। 

এ ছাড়া কোল্ডক্রাফটের ‘বায়ান্ন’, অ্যাজ অমিক্সে ‘রক্ত’, ম্যাক-ই-ম্যাক ও জিকে কিবরিয়ার ‘স্লোগান’ ও ‘ইনকিলাব’, সিয়াম ফারদিনের ‘আবু সাঈদ’, নাহিদ হাসানের ‘জবাব দেনা’, রেভ্যুলেশন ইন মোশনের ‘পাল্টে দে ইতিহাস’, ভয়েস অব রেভ্যুলেশনের ‘রাজাকার’, লুনাটিক্স বীর ও রিদমাস্ত্রের ‘দেশ কার’সহ প্রকাশিত আরো বেশ কয়েকটি গান এখন চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এখানেই শেষ নয়, নব্বই ও শূন্য দশকে প্রকাশিত দেশের প্রথম সারির ব্যান্ড মাকসুদ ও ঢাকার ‘আবার যুদ্ধে যেতে হবে’, আর্কের ‘আর কত মৃত্যু’, ওয়ারফেজের ‘জনস্রোত’ গানগুলো প্রতিবাদী জনতার মাঝে নতুন করে সাড়া ফেলতে শুরু করেছে, যা এটাই প্রমাণ করেছে, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, ইতিহাসের পটপরিবর্তনে বুলেট, বোমার মতোই বড় এক হাতিয়ার গান।

ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব গান রচিত হয়েছে তা পথ থেকে প্রান্তরে সংগ্রামের শিখা ছড়িয়েছে। এর মধ্যে অনি হাসানের ‘আমরা বীর’। শহরতলী ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সোহাগ গেয়েছেন ‘ও প্রধান’। তরুণ গায়িকা পারশা মাহজাবীনের ‘চলো ভুলে যাই’ গানটিও ভাইরাল হয়েছিল। এমনকি র‌্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ এবং র‌্যাপার হান্নান হোসাইনের ‘আওয়াজ উডা’ গান দুটিও আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছে। তাদের লেখা ও কণ্ঠ দেওয়া এই গানের জন্য তারা আটক হয়েছেন। অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। 

একই সঙ্গে আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে ‘বাংলা মা’, ‘বায়ান্ন’, ‘দেশ সংস্কার’, ‘স্বাধীনতার গন্ধ’, ‘ছাত্র’, ‘স্লোগান’, ‘অধিকার’, ‘দেশ কার’, ‘আবু সাঈদ’, ‘রক্ত’, ‘দেশ কারও বাপের না’, ‘জবাব দে’, ‘জয় বাংলা’, ‘কত খাবি’ ও ‘শকুনের চোখ’ নামের অজস্র গান। ফলে বোঝাই যায়, যুগে যুগে আন্দোলন-সংগ্রামে গানের ভূমিকা অপরিসীম। তাই ইতিহাসে স্থান করে নেয় গানগুলো। 

এসব গানের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে প্রিন্স মাহমুদের কথায় ‘নগর বাউল’ খ্যাত জেমসের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি । এসব গান আন্দোলনের মাঠে জ্বালিয়েছিল সংগ্রামের শত শত আলোকবর্তিকা। ব্যান্ডশিল্পী মাকসুদের ‘আবার যুদ্ধে যেতে হবে’ গানটিও উদ্বুদ্ধ করেছে ছাত্র-জনতাকে। ব্যান্ডের অফনেক গানই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সংগ্রামী ভূমিকায়। সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ওয়ারফেজের ‘জনস্রোত’ গানটি। সমকালীন বাংলা গানের ভুবনে ভিন্নধারার কথা নিয়ে হাজির হন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে তার ‘ভয় বাংলায়’ গানটি ছাত্র-জনতার হৃদয় স্পর্শ করেছে। 

তরুণদের জনপ্রিয় ব্যান্ড বা র‌্যাপ গানের সঙ্গে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ঝুমুর তালে লেখা ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ গানটিও। এই গানটি ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কাজী নজরুল ইসলামের ‘এই শিকল পরা ছল’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি আবেগাপ্লুত করেছে সবাইকে। একই সঙ্গে গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ গানটি সমবেত কণ্ঠে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে ধরা দিয়েছে। শাহবাগ চত্বর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসব গান শিল্পীর কণ্ঠে বারুদ হয়ে জ্বলে উঠেছে।

এ ছাড়া শূন্য ব্যান্ডের ‘শোনো মহাজন’, সোহেল আরমানের লেখা হাবীব ওয়াহিদ, আরফিন রুমি ও প্রদীপ কুমারের গাওয়া ‘হৃদয় আমার বাংলাদেশ’ গানগুলোও গীত হয়েছে এই আন্দোলনে। বিশেষ করে ইথুন বাবুর লেখা ও মৌসুমীর গাওয়া ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গানটি রক্তে আগুন লাগা ক্ষণ উপহার দিয়েছে। 

বাংলা গান গত এক হাজার বছর ধরে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে এসেছে। গানের মধ্যে যেমন সংকট, আনন্দ, দুঃখ, সমস্যা, বিরহের কথা আছে, আবার সংগ্রামের কথা আছে। বহুমাত্রিক বিচরণের কারণে নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে গান। তার মধ্য দিয়ে হয়েছে সমৃদ্ধ। গানের যে সর্বজনীন দিক আছে, তার মধ্যে সুর আছে। সেই সুরে দ্রোহের কথা বলা যায়, স্নিগ্ধতায় অবগাহনও করা যায়। গানের ভেতর দিয়ে প্রতিবাদের যে প্রকাশ সেটা আন্দোলনকে গতিশীল করে। তাই শোষকের বিরুদ্ধে-কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের হিরণ্ময় হাতিয়ার হয়েছে গান। সমাজে যতকাল শ্রেণি থাকবে, ততকাল কর্তৃত্ববাদ থাকবে, শ্রেণি শোষণ থাকবে। আবার তার বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামও থাকবে। গান সেসব সংগ্রামকে গতিশীল করবে মেহনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh