ভাষা আন্দোলনের মহান মাস ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নর এই ফেব্রুয়ারিতে বাঙালির ভাষার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছেন রফিক, শফিউর, জব্বার, আবুল বরকতসহ বাংলার দামাল ছেলেরা। ভাষার মাসে আমরা তাদের ত্যাগকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে।
ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বাংলার নিপীড়িত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা, গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকৃত নেতা।
সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে ১৮৮০ সালে জন্ম নিয়েছিল ফুটফুটে এক শিশু। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘চেগা মিয়া’। আর সিরাজগঞ্জের সেই চেগা মিয়াই তার ত্যাগী গণচরিত্র ও নেতৃত্ব গুণে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের মজলুম জননেতা ‘মওলানা ভাসানী’। ইরাকের আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদীর কাছে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ এবং ভারতের দেওবন্দে পড়াশোনা করা মওলানা হয়েও তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী সমাজতন্ত্রের অনুসারী একজন। জীবনের সুদীর্ঘ পথচলায় অনেকের কাছে তাই তিনি ‘লাল মাওলানা’ হিসেবে সম্বোধিত হন।
পাকিস্তানে বিরোধীদলীয় রাজনীতির আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন মওলানা ভাসানী। ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর ঢাকার আরমানীটোলার জনসভায় তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জ্ঞাপন করেন। পাকিস্তান আমলের প্রথম রাজবন্দিও মওলানা ভাসানী। ১৯৪৯-এর ১৩ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মিশে আছেন এক আলোকবর্তিকা হয়ে। জীবনের অসংখ্য সংগ্রামী অধ্যায়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলনে তার মহান অবদানই কেবল আজ স্মরণ করব।
ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলে অনেকেই ১৯৪৭ সালের তমদ্দুন মজলিশ গঠন থেকে ইতিহাস শুরু করেন। কিংবা পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের তথা সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য করা’র দাবিকে ভাষা আন্দোলনের শুরু হিসেবে মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল আরো আগে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে, বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডের বাইরে ভারতের আসামে। বঞ্চিত বাঙালি কৃষক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে একসময় মওলানা ভাসানী কৃতিত্বের সঙ্গে আসামের প্রাদেশিক পরিষদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর আসামের প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদের সভায় তিনিই সর্বপ্রথম বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে সেদিন তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও বলেছিলেন, ‘আমি বাংলায় উত্তর চাই’। এর মানে হলো আসাম প্রাদেশিক পরিষদে তিনি শুধু নিজে বাংলায় ভাষণ দেননি, অন্য সংসদ সদস্যদেরও বাংলায় বলাতে চেয়েছেন। বাংলা ভাষার অধিকার ও স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ভারতবর্ষের আসামেও সফল হয়েছিল। আর সেই আন্দোলনের শেষ পর্যায় ছিল ১৯৬১ সাল, যেখানে ১১ জন শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আসামেও বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। অর্থাৎ আসামের ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের পত্তন করেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ১৯৩৮ সালে।
তবে বৈশ্বিক ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন বললেই মূলত বাংলাদেশের ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালের আন্দোলনকেই বোঝায়। ঐতিহাসিক সেই ভাষা আন্দোলনেরও প্রাণপুরুষ ছিলেন মওলানা ভাসানী। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ, ১৯৪৮-এক গুরুত্ববহ দিন। ঐদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। এরপর ১৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে বাংলায় সভা পরিচালনার দাবি উত্থাপন করেন মওলানা ভাসানী। পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য করার দাবি জানান। কিন্তু মওলানা ভাসানীর বিশেষত্ব হলো, ভাসানী নিজের দাবিটাও বাংলাতেই বলেছেন। সবাই যাতে বাংলায় কথা বলে সে ব্যবস্থা করতে তিনি স্পিকারকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তখন চলমান বাজেট আলোচনায় বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলায় ও বাঙালিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরো কিছু দাবি তুললে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের বিরাগভাজন হন। ফলে সরকারদলীয়রা তাকে নানাভাবে হয়রানি করে। ততদিন পর্যন্ত ভাসানী নিজেও মুসলিম লীগের মনোনয়নে প্রাদেশিক পরিষদের সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে মুসলিম লীগের বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি নিজেই প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দম্ভোক্তি উচ্চারণ করলে বাংলার ছাত্রসমাজ পুনঃ জাগরিত হয়। সচেতন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে বিভিন্ন দল ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ৪০ সদস্যের সেই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানীর সভাপতিত্বে সেদিনের সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে সময় ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
কেবল কর্মসূচি ঘোষণা করেই ভাসানী ক্ষান্ত ছিলেন না; কর্মসূচি সফল করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়নেও তিনি নেতৃত্ব দেন। ৬ ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার যদি ১৪৪ ধারা জারি বা অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে করণীয় কী হবে তা আলোচিত হয়। সভায় মাওলানা ভাসানী বলেন, ‘আমাদের পূর্বঘোষিত নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার যদি নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে তা মাথা পেতে নেওয়ার অর্থ- স্বৈরাচারের নিকট আত্মসমর্পণ করা; যা আমরা করতে পারি না।’
২২ ফেব্রুয়ারি লাখো মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজা পরিচালনা করেন মওলানা ভাসানী। তিনি সেদিনের বিবৃতিতে বলেন, ‘ঢাকায় যাহা ঘটিয়াছে, তাহাকে নিন্দা করিবার ভাষা আমার নাই।’ তিনি পুলিশি নির্যাতনের এই ঘটনাকে কাপুরুষোচিত, নজিরবিহীন ও অত্যন্ত বর্বর বলে উল্লেখ করেন। তিনি সরকারকে বাংলা ভাষার দাবি মেনে নেওয়ার পাশাপাশি এই ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি বিধানের দাবি করেন। সেই সঙ্গে আটককৃতদের মুক্তি ও শহীদ পরিবারের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং হত্যাকাণ্ডের পরও মওলানা ভাসানীকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়েও জারি রাখেন এবং নেতৃত্ব অব্যাহত রাখেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন স্তিমিত করতে বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নেতাকে পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারিতেই গ্রেপ্তার করা হয়।
মওলানা ভাসানী ছিলেন আপসহীন নেতা। সে কারণেই গ্রেপ্তার করেও তাকে ভাষা আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। জেলবন্দি থেকেও তিনি আটককৃত ভাষা সংগ্রামীদের মুক্তিদানসহ আরো কয়েক দফা দাবিতে শুধু লেবুর রস খেয়ে রোজা পালনের সিদ্ধান্ত নেন। অনশন হিসেবে কারা অভ্যন্তরেই টানা ৩৫ দিন রোজা পালন করেন ভাসানী ও তার অনুসারীরা।
১৯৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ভাষা সংগ্রামীদের মুক্তি ও অন্যান্য দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা পত্রিকার মাধ্যমে জনগণের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে অবশেষে ২১ এপ্রিল গণমানুষের প্রিয় নেতা মওলানা ভাসানীকে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলনের জন্য এভাবেই টানা ১৬ মাস কারা নির্যাতিত হন গণমানুষের এই মহান নেতা মওলানা ভাসানী।
১৯৫৪ সালের ৭ মে মওলানা ভাসানী ও ফজলুল হক নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগে পাকিস্তানি সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন ও বরকতের মা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেদিনও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী। শেষে শহীদদের কবর জিয়ারত করেন তিনি। এ সময় ক্রন্দনরত বরকতের মাকে ‘বাংলার সাড়ে চার কোটি সন্তানের মা’ বলে উল্লেখ করেন এই মজলুম জননেতা।
বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন ও রক্তক্ষয় শেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। পাকিস্তানের সংবিধানের ২১৪(১) অনুচ্ছেদে লেখা হয়, ‘উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’
ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস পাঠকারীদের কাছে এটি পরিষ্কার যে, মওলানা ভাসানীই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একমাত্র কেন্দ্রীয় নেতা এবং পুরোধা ব্যক্তিত্ব; যার নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বেই পুরো ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। তাই মওলানা ভাসানীর যথাযথ স্বীকৃতি ছাড়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
সিরাজগঞ্জের ‘চেগা মিয়া’ থেকে পুরো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ‘মজলুম জননেতা’র স্বীকৃতি পাওয়া মওলানা ভাসানী শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলা ও বাঙালির সমকালীন গৌরবোজ্জ্বল সব ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। তার অমর কীর্তি ও অবদান বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন অম্লান থাকবে। বাঙালির কৃতী পুরুষ ও বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে মহান ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়।
লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh