সংস্কার, নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি সচেতন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিচ্ছেন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও দুই টুকরা হয়ে একদল স্থানীয় নির্বাচন আগে, আরেক দল জাতীয় নির্বাচন আগে চাইছে। দেশের মানুষ কোন নির্বাচনটি আগে অনুষ্ঠিত হওয়াকে তাদের জন্য মঙ্গলজনক ও আবশ্যক মনে করছে সেসব নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য মতামত গ্রহণ বা জরিপ হয়নি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের সব স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধির পদ শূন্য হয়ে সরকারি প্রশাসক ও ভারপ্রাপ্ত দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। অনেক এলাকায় স্থানীয় সরকার প্রধান কে মানুষ তা জানেই না। দেশের চার স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে গ্রামভিত্তিক স্থানীয় সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদের প্রতিনিধি জনগণের নয়। শহরভিত্তিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, দুই ধরনের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা। এই দুই স্তরের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় জনগণের সরাসরি ভোটে।
দেশের মানুষের জন্য জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক। কারণ স্থানীয় সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এত গভীর ও ব্যাপক যে তাদের ছাড়া প্রাত্যহিক, প্রশাসনিক, অফিশিয়াল ও নন-অফিশিয়াল অনেক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা সম্ভবপর নয়। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতিতে জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা একমাত্র ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপ করলেই বোঝা যায়।
সরকারি প্রশাসকদের সময়মতো অফিসে পাওয়া যায় না। তার ওপর আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, গ্রাম-গঞ্জের সহজ-সরল মানুষ চায় তাদের বাড়ির পাশের মানুষটি প্রতিনিধি হোক, যাকে তারা যখন তখন হাতের কাছেই পাবেন। জাতীয় প্রতিনিধি বা সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রশাসনিক বা অফিশিয়াল সম্পর্ক তেমন নেই বললেই চলে। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের যেসব দায়দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো জনসম্পৃক্ত নয়।
যদিও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সংসদ সদস্যের ইয়েসম্যান হিসেবে দেখা যায়, তথাপি তাদের নিজস্ব এলাকার মানুষের বিচার-আচার ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ তাদের মূল দায়িত্ব হিসেবে গুরুত্ব পায়। জনগণের প্রশাসনিক সব কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব পালন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তাদেরই পরামর্শ দিতে হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধীনে বা ক্ষমতাকালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে। দেশের দুর্বল ও আজ্ঞাবহ প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের ইশারা-ইঙ্গিতে উঠে বসে। জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা তাদের কোনো দিনই ছিল না, এখনো নেই। তাই আমাদের প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা, অনিচ্ছা আর ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বিপরীতে কিছুই করে না বা করতে পারে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন হলে জনগণের এক বিশাল অংশ ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে কিংবা নানা কুটকৌশল তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দান করা হবে। কারণ দেশের এক শ্রেণির নিরীহ মানুষ ভোট এলেই ভয়ে আতঙ্কে থাকে কাকে ভোট দিলে কোন বিপদে পড়ে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী যদি কোনোভাবে জানতে অথবা অনুমান করতে পাওে, ভোটার তার বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, সেই ভোটারের আপদ-বিপদ আর পিছু ছাড়বে না। তার নামে মিথ্যা মামলা হবে, তার ছেলেপুলেকে পুলিশি ঝামেলায় জড়ানো হবে। তার মেয়ে নির্ভয়ে স্কুল-কলেজে যেতে পারবে না, সারাক্ষণ তাকে এবং তার পরিবারকে আতঙ্কে দিনাতিপাত করতে হবে।
যেসব রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগেই জাতীয় নির্বাচন দাবি করছে, তাদের মতলবে অশুভ ও কুচক্রী কুটকৌশলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন হলে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে। সেই দলের আদেশ-নির্দেশ, সুপরামর্শ ও কুপরামর্শে প্রশাসনের চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত নড়াচড়া করবে। তখন তারা তাদের পছন্দের বা দলীয় প্রার্থীকে জেতানোর জন্য কুটকৌশল ঠিক করতে পারবে। কারণ প্রশাসন তো তাদের কথার বাইরে কিছু করবে না।
বিরোধী প্রার্থীকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে জেলে পাঠানো, বিরোধী প্রার্থীর জনপ্রিয় এলাকা অর্থাৎ যেসব এলাকায় বিরোধী প্রার্থীর বেশি ভোটার, সেসব এলাকায় দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে শত শত লোককে আসামি করে মামলা দায়ের করে বাড়ি ছাড়া করতে পারে, যাতে তারা ভোটে অংশগ্রহণ করতে না পারেন।
ভোটগ্রহণের দিন বিরোধী প্রার্থীর জনপ্রিয় এলাকার ভোটকেন্দ্রে মারামারি বাধিয়ে প্রশাসনকে দিয়ে ভোট বন্ধ রাখা, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের দিয়ে ভোটগ্রহণের গতি ধীর করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট বুথে ভোটগ্রহণ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা, ভোটকেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের নানাভাবে নাজেহাল করা। এমনকি ভোট গণনার সময়ও হতে পারে নানা অপকর্ম- যাতে করে বিরোধী প্রার্থী জিততে না পারে।
অনেকেই বলতে পারেন নির্বাচন তো নির্বাচন কমিশনের অধীনে হবে, ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে না। দেশের নির্বাচন কমিশন যতই স্বাধীন হোক না কেন, ভোটের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত, নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের শক্তি-সামর্থ্য-সাহস আর লোকবলের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা শুধু পরিবর্তন হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের লোকবল ও যন্ত্রপাতি সব আগের মতোই আছে। এই মেশিনারিজ দিয়েই তো বিগত সরকার দিনের ভোট রাতে করেছেন। জনগণের ভোট নিজেরা সিল মেরে বাক্সে পুরেছেন।
ক্ষমতাসীন কোনো দলের ক্ষমতাপর্বে একই নির্বাচন কমিশনার দিয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ স্থানীয় নির্বাচন হবে- এমনটা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন না হলেও ঘুরেফিরে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। দলের মার্কা থাকে না, কিন্তু দলের সব কিছুই তাদের প্রার্থী জেতানোর জন্য ক্রিয়ানকের ভূমিকা পালন করে। আমাদের প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতাপর্বেই স্থানীয় নির্বাচন হওয়া সমীচীন।
লেখক : আইনজীবী
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh