যে কারণে ঈদ যাত্রা এবারে স্বস্তিকর

মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ উদযাপন করতে প্রতি বছর রাজধানী শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে চলে যায় শেকড়ের টানে নিজ গ্রামের বাড়িতে। দূরে থাকা প্রতিটি স্বজনের কাছে ঈদে বাড়ি ফেরা একটা সুন্দর স্বপ্নের মতো। তাই ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ শিরোনামে একটি গান হয়ে উঠেছে সারা দেশের মানুষের কাছে ঘরে ফেরার গান। বিশেষত, ঈদ এলেই মনে-আনমনে সবাই গুনগুন করে গাইত এ গান। ঈদ যাত্রায় মানুষের একমাত্র ধ্যানজ্ঞানও থাকে বাড়ি ফেরার।  

কিন্তু এই বাড়ি ফেরার ঝক্কি যে কতটা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বোঝানো যাবে না। কীভাবে বাড়ি পৌঁছাবে আর কীভাবে ফিরবে, সেটা বলতে পারত না কেউ। নিরাপদে বাড়ি যাওয়া ও ফিরে আসা ছিল একমাত্র চাওয়া। সংবাদকর্মী বাদল হোসেনের বাড়ি মেহেন্দীগঞ্জ। তার বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম সেদিন। প্রায় দেড় যুগ আগের কথা। দুই দিন আগে সদরঘাটে এসেও লঞ্চে উঠতে পারলেন না তিনি। এক দিনরাত সদরঘাটে দাঁড়িয়ে-বসে কাটানোর পরে বিকেলে বরিশালের একটি লঞ্চে কোনো মতে উঠতে পারলেও ভেতরে ঠাঁই নেই, ভাড়া চার গুন বেশি। তার মধ্যে লঞ্চের ডালিতে বসে বরিশাল যাওয়া। ভোরে বরিশালে পৌঁছাল লঞ্চ। সকাল হলেই ঈদ। চারদিকে নদী- জল আর জল। আবার লঞ্চের অপেক্ষা- অবশেষে ঈদের দিন বিকেলে ঘরে ফেরা। 

কিন্তু সেই বাদল এবারে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় বাড়ি ফিরেছেন। লঞ্চে বাড়তি ভাড়া নেই, টিকিট নিয়ে ঝামেলা নেই। অপেক্ষাও করতে হয়নি। পুরো বদলে যাওয়া এক  ঈদ যাত্রা। 

নগরবাড়ি-আরিচা-শিমুলিয়া ঘাটে ১০ থেকে ১৫ কিমি অবধি যানজট কিংবা ঢাকা গাজীপুর, ঢাকা-কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত গাড়ির জট- এটা ছিল একসময় নৈমিত্তিক ব্যাপার। গোপালগঞ্জ থেকে মাইক্রোবাসে করে ঈদের যানজটে আট কিলোমিটার জটের পেছনে পড়া শিক্ষক সুমিতা চক্রবর্তী বলছিলেন তার অভিজ্ঞতার কথা। ভোর হলেও ফেরীর দুই কিলোমিটারের ভেতরে গাড়ি ছিল না। অন্যদিকে দৌলতদিয়ার হোটেলের সব খাবার বিক্রি শেষ। অনেক হোটেল বন্ধ। অবশেষে সন্তানের জন্য ভাতের খোঁজে বের হওয়া। এমন অভিজ্ঞতা ছিল প্রতি বছরের। 

ঈদের আগে ট্রেনের টিকিট চলে যেত কালোবাজারিদের হাতে। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট ছাড়ার মুহূর্তের মধ্যে টিকিট শেষ হয়ে গেছে গত বছরেও। মানুষের ভোগান্তির শেষ ছিল না। কিন্তু কেন এই কষ্ট? প্রতি বছর যেহেতু প্রধান এই উৎসবটিতে মানুষ আপনজনের কাছে ছুটে যায়, শেকড়ের টানে এই ফেরার কথা যেহেতু কারো অজানা নয়, তাহলে এর জন্য আগাম কোনো প্রস্তুতি থাকবে না কেন? 

সব পরিবহনের টিকিট কালোবাজারি, পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি, ফিটনেসহীন গাড়ি, লঞ্চ-দুর্ঘটনা এসব নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠতো। ঈদ যাত্রায় ফিটনেসবিহীন বা রুট পারমিটবিহীন গাড়ি মহাসড়কে যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটায় তার একটি চিত্র দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যাবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ঈদ যাত্রায় ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিনে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ও ৮৪৪ জন আহত হয়। সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৪৪৩ জন নিহত ও ৮৬৮ জন আহত হয়। ২০২২ সালে ঈদ যাত্রায় ৩৭২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৪১৬ জন, আহত হয় ৮৪৪ জন। ২০১৯ সালে সারা দেশে ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন মারা গেছে এবং ৮৪৯ জন আহত হয়েছে। এত সব সড়ক দুর্ঘটনায় কত পরিবারের ঈদ যে শোক উৎসবে পরিণত হতো তা বলার না। পরিবহনগুলোর যথেচ্ছাচার ছিল নিয়মিত ব্যাপার। 

পাঁচ বছর আগে দিনাজপুরের একটি গাড়ির টিকিট কাটা হলো পাঁচ গুন বেশি দামে। বগুড়া গিয়ে জানা গেল গাড়ি যাবে না। দেখার কেউ নেই। এ ধরনের ভোগান্তির মধ্য দিয়ে কষ্টকর ঈদ যাত্রার মধ্যেও মানুষ দমে যাওয়ার পাত্র নয়। শত বাধা উপেক্ষা করে সবাই যেভাবেই হোক বাড়ি যাবেই।

কিন্তু এবার ঈদের স্বস্তি ছিল অন্যান্য সময়ের চেয়ে আলাদা। বিস্ময়করভাবে ট্রেন, বাস, লঞ্চ পরিবহনের টিকিট কাউন্টারের সামনে এর আগে যে দীর্ঘ লাইন দেখা যেত, এবার সেটা দেখা যায়নি। যাত্রাপথে দীর্ঘ যানজটের কোনো খবরও পাওয়া যায়নি এবার। নির্ধারিত সময়েই প্রায় সবাই বাড়ি ফিরেছেন। ঈদ যাত্রার  এই স্বস্তির পেছনের বড় একটি কারণ ছিল টানা ৯ দিনের ছুটি। ফলে বরাবর তিন দিনের ছুটির তাড়া এবার ছিল না। এ ছাড়া মহাসড়ক, টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল। বিপরীতে এত বছরের দলীয় সুবিধাভোগী দালাল, কালোবাজারিদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। সবখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল জনবান্ধবের ভূমিকায়। ফলে দেশের অনেক জায়গায় গাড়িতে লঞ্চে বেশি ভাড়া নেওয়া বা যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ছিল সজাগ। অভিযোগ করা মাত্রই ব্যবস্থা নেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। চলার পথেও সড়কে শান্ত পরিবেশ ছিল লক্ষণীয়। এবারের ঈদ যাত্রা বিগত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক ছিল বলে সামাজিক মাধ্যম থেকে জানা গেছে। অতীতে কখনো এত সহজে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারেনি।

এটা সম্ভব হয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করার কারণে। সড়ক বিভাগ, বিআরটিএ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। এবার একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, আমাদের যাত্রাপথের নীতি আছে; কিন্তু বাস্তবায়ন নেই, সুব্যবস্থাপনা নেই। যাত্রীরা উপায় না পেয়ে অসদুপায়ের দ্বারস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। পথে দুর্ঘটনার শিকার হয় কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

ঈদে চাহিদার তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই পরিবহন কম থাকে। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিগুলো দূর করলে ঈদ যাত্রা যে ভোগান্তিহীন হয় এবারে সেটা প্রমাণিত। এমন ব্যবস্থা নিলে সব কাজই এমন ঝঞ্ঝাটহীন করা সম্ভব বলে মনে করি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh