প্রায় তিন যুগ হলো প্রতি পহেলা বৈশাখে চারুকলা ইনস্টিটিউটের চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। এই তিন যুগের মধ্যে কোনো বছরই এই শোভাযাত্রা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়নি। কিন্তু এই বছর ২০২৫ সালের আসন্ন পহেলা বৈশাখের প্রাক্কালে এমন কী ঘটল যে চারদিকে এই শোভাযাত্রা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো? ঠিক শোভাযাত্রা নিয়ে না। শোভাযাত্রার নাম নিয়ে- প্রাথমিক নাম, আনন্দ শোভাযাত্রা কবে, কীভাবে ও কেন মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে উদয় ঘটল? প্রশ্নটা এখানেই। বিষয়টা কি এমন যে, এই তিন যুগ ধরে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম নিয়ে কারোর মাথাব্যথা ছিল না, হঠাৎ করে এই ২০২৫ সালে সবার মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল?
এর উত্তর পেতে প্রথমেই আমাদের ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসকে এমন একটা বাঁকের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে যে, অতীত ইতিহাসের অনেক কিছুই আজ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু অতীত ইতিহাসের নয়, আমাদের সবাইকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষ সব থেকে ভয় পায় নিজের মুখোমুখি হতে। কারণ মানুষ নিজের মুখোমুখি হলে তার অভ্যন্তরীণ অনেক দোষত্রুটি এবং সত্য সামনে এসে ধরা দেয়। সে তখন সেটা সহ্য করতে পারে না। আর ঠিক এই ব্যাপারটাই এই বছর ঘটেছে এবং ঘটে যাচ্ছে।
‘১৮৮৪ সালের বার্লিন নীতি ছিল তরবারি আর বন্দুকের। কিন্তু তরবারি আর বন্দুকের যুগ পার হয়ে পরবর্তী সময়ে সেখানে উদয় ঘটেছিল চক আর ব্ল্যাকবোর্ডের সকাল’- কথাগুলো কেনিয়ার লেখক গুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর। তিনি তার ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ বইটিতে হামিদু কেনের উপন্যাস ‘অ্যাম্বিগিউয়াস অ্যাডভেঞ্চার’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের মহাদেশে যে কেউ বুঝতে শুরু করে, আসল ক্ষমতা প্রথম সকালের গোলার (বোমা-বারুদ) মধ্যে নয়, বরং গোলার পরে যা এসেছে সেটার মধ্যেই নিহিত। এই গোলার পেছনেই ছিল নতুন স্কুল। আর নতুন স্কুলের ছিল গোলা আর চুম্বক দুটোরই স্বভাব। গোলার কাছ থেকে নিয়েছে যুদ্ধবাজি অস্ত্রের দক্ষতা। কিন্তু গোলার চেয়েও বেশি বিজয় অর্জন করেছে নতুন স্কুল। গোলা শক্তি প্রয়োগ করে শরীরের ওপর। আর স্কুল প্রচণ্ড আকর্ষণে টানে আত্মাকে।’
ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভাষার মধ্য দিয়ে কীভাবে উপনিবেশ শাসিত অঞ্চলের মানুষের মন তথা সংস্কৃতি, আচরণ ইত্যাদি করায়ত্ত করে তারই বর্ণনা দিয়েছেন বইজুড়ে। এটাকেই উনি বলছেন নতুন স্কুল, যে স্কুল প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে আত্মাকে। আমাদের এই আত্মার নাম ‘বাঙালি সংস্কৃতি’, যা নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ নেই। জাতিবাদী এই শব্দবন্ধ স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে বেঁধে ফেলেছে। যার বাইরে আমরা যেতে পারি না। পারি না বলেই বাইরে থেকে ধার করা উৎসবের আয়োজন অনুসরণ করি।
বর্ষবরণ উৎসব রমনা বটমূলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হলেও ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বড় আকারের উৎসবে পরিণত হয়। শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? এই উৎসবের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কলকাতা থেকে আগত তরুণ ঘোষের মাধ্যমে, যেটা আমরা মাওলানা আহমাদুল্লাহর মাধ্যমে জানতে পারি। তরুণ ঘোষ কলকাতার আদলে এই উৎসবের কাঠামো নির্মাণ করেন, যা আনন্দ শোভাযাত্রা নামে প্রথম বছর পালিত হয়। পরের বছর ১৯৯০ সালে আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা, যেটা আমরা আমিনুল হাসান লিটুর মাধ্যমে জানতে পারি। আপাত নিরীহ এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটা যতটা মঙ্গলময় মনে হয়, একটু গভীরে গেলেই বুঝতে পারব, তার ভেতরে আছে সেই বাঙালি সংস্কৃতির আত্মার রাজনীতি।
আমরা যদি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলো পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, এই কাব্যগুলো ছিল মূলত বিশেষ এক শ্রেণির ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য, যা মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, যে কাব্যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্য-কীর্তন করা হয়, যে কাব্য শুনলেও মঙ্গল হয় এবং বিপরীতে অমঙ্গল হয়; যে কাব্য মঙ্গলাধার, এমনকি যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়, তাকে বলা হয় মঙ্গলকাব্য। কাব্যে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেই কাব্য যদি বিশেষ এক শ্রেণি বা গোষ্ঠীর ধর্মবিষয়ক আখ্যান হয়, তখনই সেটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার পড়ে। এবং এই কারণেই ‘মঙ্গল’ শব্দ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে। তরুণ ঘোষ কলকাতায় যেভাবে দেখেছেন হিন্দুদের বিভিন্ন প্রতিমা, দেব-দেবী, জীবজন্তুদের মুখোশ প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই উৎসব পালন করতে, আমাদের এখানেও তার অনুকরণে প্রচলন ঘটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যে উৎসবের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে, সেই সংস্কৃতি আমরা ধারণ করব কেন? বাংলাদেশের সংস্কৃতি একান্তভাবেই তার নিজস্ব সংস্কৃতি হতে হবে। ধার করা সংস্কৃতি নিয়ে কোনো সংস্কৃতি দাঁড়াতে পারে না। এবং ঠিক এই জায়গাতেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাহাত্ম্য। এই কারণেই আনন্দ শোভাযাত্রা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রায় আপত্তিগুলো নতুন করে উঠে এসেছে, যা এর আগে কখনো হয়নি। আমাদের যা শেখানো হয়েছে, অন্ধের মতো আমরা সেসব অনুসরণ করে গেছি। বাংলা শব্দ এবং ভাষা ক্রমেই তাই ফোর্ট উইলিয়ামের ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শুধু একজন স্বৈরাচারের পতন নয়, স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সবকিছুর পতন। যে পতনের মধ্য দিয়ে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে বা যাবে, যে ব্যবস্থা একান্তভাবেই বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ব্যবস্থা, কোনো বিদেশি ব্যবস্থার অনুকরণ নয়।
শিল্পীরা এক ভিন্ন জগতের মানুষ। যে জগৎ নিয়ে শিল্পীরা তাদের মতো করে সুখে থাকে। চারুকলা অনুষদের ছাব্বিশতম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা এবারের বর্ষবরণের শোভাযাত্রা বর্জন করলেও এই প্রতিষ্ঠানের অন্যসব ছাত্রছাত্রী মন দিয়ে উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠেছে। দিনরাত তারা এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। মঙ্গল বা আনন্দ শোভাযাত্রা তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। এবারের উৎসবের আয়োজনে চারুকলা অনুষদ অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। ফ্যাসিবাদবিরোধীতা থাকছে এবারের মূল থিম। ফ্যাসিবাদী হাসিনার প্রতিকৃতি ছাড়াও থাকছে কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, পাখি ইত্যাদি। তবে লক্ষণীয়, এবারই প্রথম মোগল সাম্রজ্যের সম্রাটদের প্রতিকৃতিও নিয়ে আসা হচ্ছে। আমরা জানি মোগল সম্রাট আকবরের মাধ্যমেই বাংলা নববর্ষের গণনা শুরু হয়। বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রে তাই মোগল সম্রাটদের অবদান অনস্বীকার্য। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদের মূর্তি গড়ার পরিকল্পনা থাকলেও পরে তার পরিবারের আপত্তির কারণে বাতিল করা হয়। শহীদ মুগ্ধের পানির কথা বাংলাদেশ কখনো ভুলতে পারবে না। তাই তার স্মরণে বিশাল আকারের পানির বোতল নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ভেতরে আরো ছোট ছোট বোতল রেখে অন্য সব শহীদকে স্মরণ করা হবে। সব থেকে বড় যে পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে, সেটা হলো বাংলাদেশের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর উপস্থিতি। ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র মধ্য দিয়ে অতীতে যেভাবে আমরা আমাদের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে অবহেলা করেছি, এবারের আয়োজনে সেটা একেবারেই বাতিল করে, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষের সঙ্গে তাদের যুক্ত করা হচ্ছে। এই যে সবার সঙ্গে সবার যুক্ত হওয়া, যুক্ত করা- এটাই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব থেকে বড় প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির কথা আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh