
টাকা জাদুঘর। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
টাকার গাছ! ভাবুন তো, গাছজুড়ে দেখছেন শুধুই টাকা আর টাকা।
ছোটবেলায় এমন স্বপ্ন ছিল একটা টাকার গাছ থাকবে। সেখানে ঝাঁকি দিলে ঝরঝর করে পাতার মতো ঝরে পড়বে অজস্র টাকা। আর সেই টাকা দিয়ে কিনে খাব অনেকগুলো টফি। স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নেয় না।
হাঁটতে হাঁটতে একদিন হঠাৎ চোখে পড়ে টাকা জাদুঘর। কৌতূহল নিয়ে ঢুকে পড়ি। ঢুকেই চোখ ছানাবড়া। জাদুঘরে টাকার গাছ! কত যে টাকা সেখানে। কাঁচা টাকা, সোনার টাকা, রুপার টাকা, পিতলের টাকা! এ দেশের টাকা, ভিন্ন দেশের টাকা! দেখে চোখ চমকে ওঠে।
ঢাকার মিরপুরে এই জাদুঘরে রয়েছে প্রাচীন বাংলার মুদ্রা থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের ধাতব মুদ্রা এবং কাগুজে নোট; যা দেখে মুগ্ধ খুদে, বড় দর্শনার্থীরা।
সিয়াম নামে এক খুদে দর্শনার্থীকে জিজ্ঞাসা করলাম, অনেক টাকা পেলে কী করতে চাও? উত্তরে জানায় বড় এক লাল গাড়ি কিনবে সে। নাবিহার আবার ইচ্ছে চাঁদে যাবার। বড় এক ক্রিকেট ব্যাট কিনতে চায় রোহান।
মুগ্ধতা নিয়ে শিশুরা এখানে দেখে নানা ধরনের টাকা। অভিভাবকরাও শিশুদের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে দেখছেন বিভিন্ন দেশের টাকার আকৃতি।
প্রথম মুদ্রাকে ‘টঙ্কা’ বা ‘টাকা’ হিসেবে পরিচিত করেন গজনীর সুলতান মাহমুদ। পরে দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ তার স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার নাম দিয়েছিলেন ‘তানকাহ’ বা ‘টাকা’।
টাকা জাদুঘরে রয়েছে প্রাচীন আমল থেকে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন ধরনের ধাতব মুদ্রা, কাগজের নোট ও মুদ্রা সম্পর্কিত দ্রব্যসামগ্রী। আছে উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত পাঞ্চ মার্কড (রৌপ্য মুদ্রা), কুষাণ মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, দিল্লি ও বাংলার সুলতানদের মুদ্রা, মোগল ও ব্রিটিশ শাসকদের মুদ্রা।
১৯ শতক পর্যন্ত বাংলায় ক্ষুদ্র লেনদেনে যে কড়ি ব্যবহার করা হতো, তাও আছে এখানে। রয়েছে মোগল সময়ের ‘কোচ’ ও ‘অহম’ বা ‘আসাম’ মুদ্রা। এ ছাড়াও আছে ব্রিটিশপরবর্তী পাকিস্তান আমল, স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা ও কাগজের নোটের ধারাবাহিক ইতিহাস।
শুধু মুদ্রা বা নোট নয়, আছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কার, শস্য সংরক্ষণে রাখা মাটির মটকিসহ নানা কিছু। এ ছাড়া গ্যালারিতে বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশের প্রায় ৩ হাজার পুরনো মুদ্রা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে মুদ্রা দিয়ে বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরি করা হতো। টাকা জাদুঘরে মুদ্রার পাশাপাশি এসব অলঙ্কারও সংরক্ষিত আছে।
পাশাপাশি মুদ্রা সংরক্ষণের কাঠের বাক্স, লোহার তৈরি ব্যাংক, লোহার সিন্দুক ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন মেয়াদে চালু হওয়া নোটও রয়েছে এখানে। এন্টার্কটিকা এবং ওশেনিয়া মহাদেশের মুদ্রাও আছে টাকা জাদুঘরে। স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত হওয়া ২ টাকা, ১০০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোটের দেখাও মিলবে জাদুঘরে। রয়েছে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্মারক মুদ্রাও। গুরুত্বপূর্ণ স্মারক মুদ্রাগুলোর মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০০০, বাংলাদেশ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ-২০১১, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর-২০১১ ইত্যাদি। কাগুজে নোটের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর-২০১২, জাতীয় জাদুঘরের ১০০ বছর পূর্তি-২০১৩ ইত্যাদি।
জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর ড. আছিয়া লিখন জানান, বহু মানুষ দুষ্প্রাপ্য সব মুদ্রা এই জাদুঘরে দান করেছেন। কিছু মুদ্রা কেনাও হয়েছে। যে কেউ চাইলে এখানে মুদ্রা দান করতে পারেন। তিনি জানান এখানে অডিওর মাধ্যমে শোনা যায় বিভিন্ন মুদ্রা সৃষ্টির ইতিহাস। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম টাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে।
ঢাকা জাদুঘরের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই ‘টাকা গাছ’ নামের এক শিল্পকর্ম রয়েছে। ধাতব এবং কাগুজে নোটের আদলে ‘টাকার গাছ’ তৈরির পরিকল্পনায় ছিলেন শিল্পী হাশেম খান। সঙ্গে কাজ করেছেন শিল্পী শ্যামল চৌধুরী। পাশাপাশি জাদুঘরের দেয়ালে পোড়ামাটির ফলক তৈরি করেছেন শিল্পী শ্যামল চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান এবং মুকুল মুৎসুদ্দী।
জাদুঘরে চাইলে ৫০ টাকায় এক লাখ টাকার বিনিময় অযোগ্য স্মারক নোটে নিজের ছবি ছাপানো যায়। এ ছাড়া ডিজিটাল সাইনেজ, এলইডি টিভি, থ্রিডি টিভি, ফটো কিয়স্ক, প্রোজেক্টর এবং স্যুভেনির শপ স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে।
কোনো প্রবেশমূল্য ছাড়াই জাদুঘর খোলা থাকে শনি থেকে বুধবার, সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। বৃহস্পতি ও শুক্রবার জাদুঘর বন্ধ রাখা হয়।
কীভাবে যাবেন? ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে মিরপুর ২ নম্বর সেক্টরে এসে রিকশা বা হেঁটে শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তলায় টাকা জাদুঘরে পৌঁছতে পারবেন।
তো এক কমলা রঙ বিকাল ঘুরে আসুন পরিবারের সবাই মিলে টাকা জাদুঘরে। দেখে আসুন টাকার কত রঙ। কত ঢং। দেখতে দেখতে ভাবুন সেই প্রবাদ.. টাকা কি গাছে ধরে?