
বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এ জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়।
জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফর্ম রাখা হয়েছে। দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জাম স্থান পেয়েছে এখানে।
নান্দনিক এ জাদুঘরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। গ্যালারির দুই পাশের দেয়ালে আছে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ সব আলোকচিত্র। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রায় দুই হাজার বইয়ের সমন্বয়ে এক মনোরম লাইব্রেরি। বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকার দুটি সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে। সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুলিশ বাহিনীর নানান স্মৃতিচিহ্ন, অস্ত্র পোশাক-দলিলাদি। আছে বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহার করা রিভলবার। পাশেই শোভা পাচ্ছে একাত্তরের ২৫ মার্চ প্রথম প্রতিরোধের রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্র করা সেই পাগলা ঘণ্টা।
দর্শনার্থীরা জাদুঘরে আরও দেখতে পাবেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের ব্যবহৃত চেয়ার, যুদ্ধের সময় উদ্ধার করা গুলি ও মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হ্যান্ডমাইক, যুদ্ধের সময় দূর থেকে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য পুলিশ বাহিনীর সার্চ লাইট, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টেলিকম ভবনের দেয়াল ঘড়ি, যুদ্ধকালীন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন চিঠিপত্র, ২৫ মার্চ রাতে সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেওয়া হেলিকপ্টার ব্যাজ, বেতার যন্ত্র, ওয়্যারলেস সেট, পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেঞ্চ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের তৎকালীন মিনিয়েচার থ্রিডি মডেলসহ নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এ জাদুঘরে আরও আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহার করা ৭.৬২ এমএম রাইফেল, রিভলবার, ২ ইঞ্চি মর্টার এবং মর্টারশেল, ৩০৩ এলএমজি, মেশিনগান, ৭.৬২ এমএম, এলএমজি .৩২ বোর রিভলবার, .৩৮ বোর রিভলবার, ১২ বোর শটগান ও ৯ এমএম এমএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের সমাহার।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের একজন ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, একজন ডিএসপি, একজন এসডিপিও, ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ ৭৫১ জন পুলিশ শহীদ হন। তাদের অনেকের স্মৃতিচিহ্ন যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে এই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
এ প্রসঙ্গে জাদুঘরের কর্তব্যরত উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা। তাদের সেই স্মৃতি ও আত্মত্যাগকে ধরে রাখতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে এই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।’
জাদুঘরে একটি আর্ট গ্যালারিও নির্মাণ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আর্ট গ্যালারির কাজ প্রায় শেষের দিকে; এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামিদামি ও শৌখিন আর্টিস্টদের পাঠানো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক হাতে আঁকা সেরা ছবিগুলো স্থান পেয়েছে এই আর্ট গ্যালারিতে। এ ছাড়া রয়েছে অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষ ও অডিটরিয়াম। অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যায়। অডিটরিয়ামে দেখানো হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র।
জাদুঘরটি পরিদর্শনে প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং শীতকালে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে।