সাঁওতাল বিদ্রোহ: গণসংগ্রামের ইতিহাসের একটি আদমসুরত

দীপংকর গৌতম
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ১৬:৫৭

প্রতীকী ছবি
ইংরেজ বেনিয়াদের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরাই প্রথম ডাক দিয়েছিল সংগঠিত বিদ্রোহের। এই সংগ্রামে শুধু সাঁওতালরা নয়, অংশগ্রহণ করেছিল তাঁতি, ডোম, চর্মকারসহ বঞ্চিত সব সম্প্রদায়ের মানুষ। সবাই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ইংরেজ বেনিয়ার বিরুদ্ধে ডাকা ‘হুল’-এ (সাঁওতাল বিদ্রোহকে তাদের ভাষায় ‘হুল’ বলে) হাজির হয়েছিল সংগ্রামের পিলসুজ হাতে নিয়ে।
সিধু, কানু ও চাঁদ ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল গণসংগ্রামের একটি মাইলফলক। এই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল বীরভূম থেকে বাকুড়া, মুর্শিদাবাদ, পাকুর, দুমকা, পূর্ণিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল অবধি। এত বড় স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ইংরেজ বেনিয়ারা তাদের শাসনকালে আর দেখেনি। শাসক শ্রেণির প্রবল প্রতাপ মিইয়ে গিয়েছিল সাঁওতালদের সংগ্রামী উত্তাপে।
বিদ্রোহের প্রধান কারণ
সাঁওতাল ও তাদের সমগোত্রীয় শাখাসমূহ ভারতবর্ষের বিহারে জঙ্গল কেটে তাদের বসতি স্থাপন করে। কিন্তু বিহার ইংরেজ শাসনের অধীনস্থ হলে ইংরেজ বণিকদের শোষণ প্রকট আকার ধারণ করে। সেখান থেকে সাঁওতাল ও সমগোত্রীয় জনগোষ্ঠীগুলো ১৭৯০ সালে বঙ্গ-বিহার সীমান্তে এসে জমিদারদের জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ করে প্রথমে বীরভূমে; পরে বাকুড়া, মুর্শিদাবাদ, পাকুর, দুমকা, পূর্ণিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে মূল আস্তানা গড়ে দামিন-ই-কো নামে ভাগলপুরের একটি জায়গায়। দামিন-ই-কো বা সাঁওতাল পরগনার দুর্গম বন পরিষ্কার করে এরা ফলালো সোনার ফসল। বাঘ-ভালুকের হিংস্রতাকে জয় করে ফসলের মাঠ গড়ে সাঁওতালরা।
সাঁওতালদের এই শ্রম-ফসলকে ধূর্ততার জালে আবদ্ধ করে শোষণ করতে শুরু করে স্থানীয় জমিদার ও মহাজনরা। ইংরেজ বণিকরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা ফেঁদে মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি নিয়ে আসতে শুরু করে। সাঁওতালদের ফসল বিদেশে রপ্তানি করা হতো উচ্চ মূল্যে আর তাদের দেওয়া হতো নামমাত্র মূল্য। অন্যদিকে মহাজনরা ফসল কাটার মৌসুমে সিঁদুর মাখানো পাথরের টুকরাকে নির্ভুল বাটখারা হিসেবে ব্যবহার করে ওজনে কারচুপি করত। এই ফাঁদে পড়ে সাঁওতালদের ঋণের পরিমাণ কমেনি, বরং সর্বস্ব হারায়। এই ঋণ চুকাতে তাদের বিক্রি করে দিতে হতো ফসল, হালের বলদ, শেষ পর্যন্ত নিজেকে।
বিদ্রোহের শুরু
স্থানীয় সামন্ত জমিদার ও তাদের গোমস্তা, পেয়াদা; সুদখোর মহাজন, তাদের পাইক-বরকন্দাজ, লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে দারোগা-পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সাঁওতালরা। শেষ পর্যন্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তাদের। সেই সময়ে বিদ্রোহ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব-এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে শুরু হয় গণসংগ্রাম। সিধু-কানু ঠাকুরভক্ত সাঁওতালদের ভেতরে প্রচার করতে পেরেছিলেন যে, ঠাকুরের নির্দেশেই এই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
যা ঘটেছিল ৩০ জুন
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভগনা ডিহি গ্রামে ৪০০ গ্রামের ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষকের বিরাট জমায়েত হয়। এই সভায় সিধু-কানু ভাষণ দেন এবং সিদ্ধান্ত হয়, মহাজনদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করবে। এই সমাবেশের পর সিধুর নেতৃত্বে কির্তা, ভাদু ও সুন্নোমাঝির মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের ভাগলপুরের কমিশনার, কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট দিগী থানা ও টিকরী থানার দারোগা এবং কয়েকজন জমিদারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। দারোগা ও জমিদারের কাছে ১৫ দিনের মধ্যে চিঠির উত্তর দাবি করা হয়। চিঠির জবাব না পেয়ে সাঁওতাল নেতারা ঘোষণা দেন যে, তারা বাঙালি ও বিহারি মহাজনদের উচ্ছেদ করে সাঁওতাল পরগনায় নিজস্ব স্বাধীন ব্যবস্থা কায়েম করবেন।
সমাবেশের পর সমতল ক্ষেত্রের উপর দিয়ে কলকাতা অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে ছিল ৩০ হাজার সাঁওতাল। কিন্তু অপরিণামদর্শী এই অভিযানে পথ চলতে গিয়ে কয়েক দিনেই খাবার ফুরিয়ে যায়। এরপর ক্ষুধায় তারা খাবার কেড়ে খেতে শুরু করে। অভিযানের নৈতিকতায় এ কারণে ধস নামে। তারা বেশ কয়েকজন জমিদার মহাজনকে হত্যাও করে। থানা পুলিশদেরও তারা বেঁধে রাখে কোথাও কোথাও। এক পক্ষকাল ধরে বিদ্রোহীরা পশ্চিমের জেলাগুলোতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
বিদ্রোহ দমন
বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকার জোতদারদের সহায়তায় ভাড়াটে সৈন্য ও হাতির দল পাঠিয়ে সাঁওতালদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়, হত্যাকাণ্ড চালায় এবং তাদেরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু হার মানে না নিপীড়িত সাঁওতালরা। এ সময় সামরিক আইন জারি করে ব্রিটিশরা কামান ও হাতিসহ বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাঁওতাল পরগনায় হত্যার তাণ্ডবে মেতে ওঠে। একমাত্র হাতিয়ার তীর ধনুক নিয়ে এই অসম যুদ্ধে সাঁওতালরা পেরে ওঠে না।
পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ
সাঁওতালদের মধ্যে হতাশা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে; সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও। প্রাণ দেন কানু। চাঁদ ও ভৈরব ভাগলপুরের কাছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে প্রাণ দেন। ইংরেজ বাহিনী এখানে যুদ্ধ করেনি। একটি বিদ্রোহকে দমন করতে গণহত্যা চালিয়েছে। বীর সাঁওতালরা ইংরেজদের কাছেও ক্ষমা চায়নি কখনো। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটুট থেকেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে বন্ধ করলেও ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে। আট মাসব্যাপী ‘হুল’ বা সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রায় ২৫ হাজার সাঁওতাল প্রাণ দিয়েছিল।
বিদ্রোহের অবসান আপাত অর্থে হলেও সাঁওতালদের খুশি করতে ব্রিটিশ সরকার তাদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপরও এটাই সত্য যে এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূলে ব্যাপক আঘাত করেছিল।