অ্যাক্সোলোটল স্যালামান্ডার মৃত্যু ছুঁতে পারে না যে প্রাণীকে

এহতেশাম শোভন
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:০২

অ্যাক্সোলোটল স্যালামান্ডার। ছবি: সংগৃহীত
‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর, হায় রে জীবন-নদে?’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা এই পংক্তিটি আমরা সবাই জানি। মৃত্যু এক চরম সত্য। কোনো কিছুই যে চিরস্থায়ী নয়, সে কথা মৃত্যুই বুঝিয়ে দিয়ে যায় জীবনকে। কে-ই বা আর অমর থাকতে পারে। মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়- এ তো সবাই জানে; কিন্তু তাই বলে কি পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণী নেই, যে অমর? এই গবেষণা বহুদিন ধরেই করছেন বিজ্ঞানীরা।
অবশেষে পাওয়া গেল তার উত্তর। বিজ্ঞানীরা এমন একটি প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন, যে তার সমস্ত অঙ্গ পুনরুজ্জীবিত করতে পারে নিজে থেকেই। এক কথায়- মৃত্যু ছুঁতে পারে না এই প্রাণীটিকে। প্রাণীটির নাম মেক্সিকান স্যালামান্ডার, যা অ্যাক্সোলোটাল বা অ্যাক্সোলোটল নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি কোনো মাছ নয়, একটি উভচর প্রাণী। প্রজাতিটি মেক্সিকোর বেশ কয়েকটি হ্রদে পাওয়া গিয়েছিল, যেমন জোছিমিলকো হ্রদ।
অ্যাক্সোলোটল সালামান্ডার লম্বায় ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এদের শরীরটি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং গোলাকার। এদের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় অঙ্গ হলো- ফুলের মতো গিল, যা মাথার দুই পাশ থেকে বেরিয়ে থাকে। এই গিলগুলো তাদের ফুসফুসের পাশাপাশি পানির অক্সিজেন গ্রহণে সাহায্য করে। অ্যাক্সোলোটল সাধারণত কালো বা বাদামি রঙের হয়ে থাকে। তবে মানুষের পালিত অ্যাক্সোলোটলের মধ্যে কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন রঙের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। যেমন- সাদা, গোলাপি ও অ্যালবিনো অ্যাক্সোলোটল। সালামান্ডারের অন্যতম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো- তাদের পুনর্জন্ম ক্ষমতা। তারা তাদের হারানো অঙ্গ যেমন- পা, লেজ, এমনকি মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পুনর্জন্ম করতে পারে। এই ক্ষমতা অ্যাক্সোলোটলকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। এরা
প্রাকৃতিকভাবে মেক্সিকোর সোচিমিলকো এবং চালকো হ্রদে বসবাস করে। যদিও এই হ্রদগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার কারণে বন্য অ্যাক্সোলোটল এখন বিপন্ন। বর্তমানে এটি পোষা প্রাণী হিসেবে অনেকের কাছেই জনপ্রিয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে।
অ্যাক্সোলোটল প্রধানত ছোট মাছ, পোকামাকড় ও কেঁচো খেয়ে বেঁচে থাকে। তারা সাধারণত দিনে সক্রিয় থাকে এবং রাতে খাদ্য সংগ্রহ করে। প্রজননের ক্ষেত্রে অ্যাক্সোলোটল ডিম দেয় এবং সেই ডিমগুলো পানিতে ফেটে ছোট ছোট অ্যাক্সোলোটলে পরিণত হয়।
১৯৬৪ সালে অ্যাক্সোলোটল নিয়ে গবেষণা শুরুর পর বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে, এর মস্তিষ্কের অংশগুলো কখনও নষ্ট হয় না। এমনকি সময় সময়ে তার বিকাশ ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- সব প্রাণীরই মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে সব অংশের বিকাশ ঘটে। তা হলে এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কীভাবে? এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানাচ্ছেন- একটা নির্দিষ্ট সময় পর, যখন প্রাণীটি তার জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে যায়, তখন সে মস্তিষ্কের অংশগুলো আবার পুনরুজ্জীবিত করে। ফলে সে তার যৌবনে ঠিক যেমন ছিল, তেমনই হয়ে যায়। সাধারণত যে কোনো প্রাণীরই একটা সময় মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ধীরে ধীরে অকেজো হতে শুরু করে; কিন্তু অদ্ভুত এই প্রাণীটির জীবনে মৃত্যু বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই। কারণ এই প্রাণীটির বিশেষত্ব হলো এটি তার মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড, হৃৎপিণ্ড এবং হাত-পা পুনরুজ্জীবিত করে।
অ্যাক্সোলোটল মস্তিষ্কের কোষগুলোকে পুনরায় বিকাশ করে এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে; কিন্তু কীভাবে সে নিজেকে যৌবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে? এই উত্তর জানার জন্য বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীর হৃৎপিণ্ডের একটি মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। তার পর তারা জানতে পারেন, কীভাবে অ্যাক্সোলোটল মস্তিষ্কের পুনর্বিকাশ করে। তারা জানান, অ্যাক্সোলোটলের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন কোষ বিভিন্ন কাজ করে। বিজ্ঞানীরা প্রাণীটির মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ, টেলেন্সফালন নিয়ে গবেষণা করেছেন। টেলেন্সফালনকে মানুষের মস্তিষ্কের একটি বড় অংশও বলা হয়। এর ভেতরে রয়েছে নিওকর্টেক্স, যা যে কোনো জীবের আচার-আচরণ ও অনুভূতি সম্পর্কে জানায়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই প্রাণীর নিওকর্টেক্স অন্যান্য প্রাণীর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। ধীরে-ধীরে বিজ্ঞানীরা এর মস্তিষ্কের টেলেন্সফালনের একটি বড় অংশ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন, অ্যাক্সোলোটাল খুব ধীরে-ধীরে হলেও প্রতি সপ্তাহে তার মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়। আর এই সব কিছুই ধাপে ধাপে ঘটে। তবে এই শক্তি অন্য কোনো জীবের মধ্যে এর আগে দেখা যায়নি।
বন্য অ্যাক্সোলোটল বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে। জলের দূষণ, আবাসস্থল ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক জলাশয় কমে আসার কারণে বন্য অ্যাক্সোলোটলের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। তাদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সংরক্ষণ কার্যক্রম চালু রয়েছে। অ্যাক্সোলোটল তাদের আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য ও চমকপ্রদ ক্ষমতার জন্য প্রাণীজগতের এক বিশেষ সদস্য।