Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

মহেঞ্জোদারো

হারিয়ে যাওয়া এক উজ্জ্বল সভ্যতা

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৬

হারিয়ে যাওয়া এক উজ্জ্বল সভ্যতা

প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান মহেঞ্জোদারো। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ‘মহেঞ্জোদারো’। যদিও ‘নেচার’ ম্যাগাজিনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে নগরটিকে প্রায় আট হাজার বছরের পুরনো বলে দাবি করা হয়। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি মানব সভ্যতার এক অসামান্য উদাহরণ। আজকের দিনে কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়; বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাচীন প্রযুক্তির অগ্রগতির প্রতীক হিসেবেও এটি মূল্যবান।

মহেঞ্জোদারো প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯২২ সালে। প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানটি খুঁজে বের করেন। ১৯৩০-এর দশকে জন মার্শাল, আর্নেস্ট ম্যাককিসহ কয়েকজন প্রত্নতত্ত্ববিদ এখানে খননকাজ পরিচালনা করেন এবং সেই সঙ্গে উঠে আসে এক বিস্ময়কর শহরের রূপ। ৪০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল এই শহর আবিষ্কার করতে। ইউনেস্কো এ শহরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে ১৯৮০ সালে। মহেঞ্জোদারোর নগর পরিকল্পনা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে যে, এই শহরটি তাদের সময়ের তুলনায় উন্নত ছিল।

মহেঞ্জোদারো শহরটি নির্মাণ করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৬ শতাব্দীর দিকে। খ্রিস্টপূর্ব ১৯ শতাব্দীতে সিন্ধু সভ্যতার পতন হলে তখন থেকেই মহেঞ্জোদারো পরিত্যক্ত হয়। মহেঞ্জোদারোর সঙ্গে অন্য নগরীর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল পানিপথ। তাই এ অঞ্চলে বাইরের মানুষের আগমন খুব কঠিন ছিল। এ অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রচলন ছিল বেশি। তবে মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে বাস্তবতানির্ভর তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। অনেকটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা কল্পকাহিনী।

ধারণা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল মহেঞ্জোদারো। ওই সময় মহেঞ্জোদারো ছিল দক্ষিণ এশিয়ার এক সমৃদ্ধশালী নগরী। এই শহরের নগর পরিকল্পনা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবস্থা ছিল অন্যান্য শহর থেকে অনেক এগিয়ে। শহরটি পরিকল্পিত রাস্তা এবং ভবনের সারি নিয়ে তৈরি হয়েছিল, যা গ্রিড প্যাটার্নে সাজানো। রাস্তার পাশে বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল পোড়া ইট দিয়ে, যা আজকের দিনেও টিকে আছে। প্রতিটি বাড়িতে, এমনকি বহিরাঙ্গনেও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা ছিল। বাড়িগুলোতে ছিল কূপ এবং স্নানাগার, যা প্রাচীন নগরীর মানুষের ব্যক্তিগত স্যানিটেশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতনতার প্রমাণ দেয়। 

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, মহেঞ্জোদারোতে ছিল একটি মহাশস্যাগার। গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর গাড়ি করে আনা শস্য জমা রাখা হতো এই শস্যভাণ্ডারে। শস্য শুকিয়ে রাখারও ব্যবস্থা ছিল এখানে। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ জোনাথান মার্ক কেনোয়ার এটিকে শস্যাগার বলতে রাজি হননি। তার মতে, এখানে শস্য জমা রাখার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শহরের কেন্দ্রে থাকা কেন্দ্রটিকে তিনি ‘মহাকক্ষ’ বা ‘গ্রেটহল’ নামে অভিহিত করেন। ধারণা করা হয়, ধর্মীয় বা সামাজিক কাজের জন্য এটি ব্যবহার হতো; কিন্তু ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটা শহরের মধ্যে বিশাল শস্যভাণ্ডার, স্নানাগার সত্যিই কল্পনা করা যায় না। বিশেষত, মহেঞ্জোদারোর স্নানাগার এবং শস্যভাণ্ডারের নিখুঁত নকশা তাক লাগিয়ে দেয়। 

মহেঞ্জোদারোর অন্যতম বিস্ময়কর দিক ছিল এর সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, যা ছিল বর্তমান সময়ের মতোই আধুনিক। নগরীর প্রতিটি বাড়ির জন্য পৃথক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল, যা সরাসরি রাস্তায় নেমে আসা পয়ঃনিষ্কাশন নালায় যুক্ত ছিল। এ ছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড় বড় কূপ ছিল, যা শহরবাসীর পানি সংগ্রহের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করত। এটি প্রমাণ করে যে, মহেঞ্জোদারোর নগর পরিকল্পনা অত্যন্ত আধুনিক এবং উন্নত ছিল।

শহরের রাস্তাগুলোও এলোপাতাড়ি তৈরি হয়নি। প্রত্যেকটি রাস্তারই একটা নির্দিষ্ট ধারা ছিল। এ থেকে অনুমান করা হয়, মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের গণিতশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। 

মহেঞ্জোদারোতে খননকৃত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে বোঝা যায়, এ শহরের মানুষ কৃষি, মৎস্য, এবং বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তারা ধান, গম এবং অন্যান্য শস্য চাষ করতেন। নদীপথে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের সুযোগ থাকায় মহেঞ্জোদারো ছিল একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যা নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।

মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকে উন্নত ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সেখানে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি এবং অন্যান্য ধর্মীয় নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে- তাদের ধর্মীয় চর্চা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মহেঞ্জোদারোর পতন কীভাবে ঘটেছিল তা আজও এক রহস্য। কিছু গবেষক মনে করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- বন্যা বা ভূমিকম্পের কারণে শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অন্যরা মনে করেন, শত্রুদের আক্রমণের ফলে এটি ধ্বংস হয়। তবে একথা প্রায় নিশ্চিত যে, মহেঞ্জোদারো একসময় হঠাৎ করেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং নগরীর জীবন থমকে যায়; কিন্তু কেন মহেঞ্জোদারো জনমানবহীন হয়ে পড়ল, সেই রহস্যের সমাধান এখনো করা যায়নি। শোনা যায়- মহেঞ্জোদারো নাকি প্রায় সাতবার ধ্বংস করে সেই পুরনো শহরের ওপরই নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ২৫০ একর জমির ওপর ঢিপির নিচে লুকিয়ে ছিল মহেঞ্জোদারো।

মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন স্তূপ থেকে খুঁজে পাওয়া গেছে ওই সময়ের বিভিন্ন মূর্তি, যেগুলোর অধিকাংশই ভাঙা। এই মূর্তিগুলো ঐতিহাসিক গবেষণার কাজে বা সিন্ধু সভ্যতাকে আরও বিস্তারিতভাবে জানার কাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যাওয়া এই সভ্যতা এখনো অনেকের কাছে রহস্যের আঁধার।

বর্তমানে মহেঞ্জোদারো ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি শুধু পাকিস্তানের নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অমূল্য ধন। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এবং গবেষক মহেঞ্জোদারোতে আসেন এই বিস্ময়কর স্থানটি দেখার এবং প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫