
বিশালাকার বৃক্ষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ও বিশালাকার বৃক্ষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ তারা আমাদের পরিবেশের অন্যতম প্রাণশক্তি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব বৃক্ষ হারিয়ে যাচ্ছে; তাদের ক্লোন করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।
দুই দশক আগের কথা। পরিবেশবাদী লেখক জিম রবিন্স লক্ষ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার উত্তর রকি পর্বতমালার বহু শতাব্দী পুরনো পন্ডেরোসা পাইন গাছগুলো হঠাৎ মারা যেতে থাকে। পরের বছর মৃত গাছের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। এর পেছনে রয়েছে ইঞ্চি দেড়েকের গুবরে পোকা। তারা ওই গাছগুলোতে গর্ত করে বাসা তৈরি করে। কাণ্ড ফাঁপা হয়ে গাছগুলো ভেঙে পড়ছিল। আকাশছোঁয়া গাছগুলো বিবর্ণ হতে থাকে। তিন বছরের মধ্যেই ওই বনের প্রায় ৯০ শতাংশ গাছ মারা যায়।
গুবরে পোকাকে প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হলেও এ পোকা তো আগেও ছিল। প্রশ্ন হলো- এখান এমন কী হলো যে, গুবরে পোকাগুলো ঘাতক হয়ে উঠল। তাপমাত্রার পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ খুঁজতে সহায়ক হতে পারে। রকি পর্বতমালায় আগে রেকর্ড পরিমাণ ঠান্ডা ছিল মাইনাস ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৭০ সালেও শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৪ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেত। আজকাল শীতকালে ন্যূনতম তাপমাত্রা খুব কমই মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর নিচে নামে। দুই-এক দিনের জন্য হয়তো তাপমাত্রা কমে; কিন্তু তা ওই গুবরে পোকাগুলো মরার জন্য যথেষ্ট ঠান্ডা নয়। এটি শুধু একটি বনের কথা নয়; উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে গাছ মারা যাচ্ছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ২০০৬ ও ২০০৭ সালে প্রায় ৮০ শতাংশ পুরনো গাছ মারা গেছে। কয়েক বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় ১২৯ মিলিয়ন গাছ মারা যায়।
প্রাচীন গাছগুলো কার্বনের বড় ধারক, যা জলবায়ুতে কার্বন গ্যাসের পরিমাণ কমাতে ভীষণ জরুরি। উষ্ণায়ন থেকে বাঁচতে কার্বন ধারণের বিকল্প নেই। সবচেয়ে বড় ১ শতাংশ গাছ মোট ৫০ শতাংশ কার্বন ধারণ করে। সমস্যা সমাধানে বৃক্ষের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিজ্ঞানী সুজান সিমার্ড। তার মতে, গাছেদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এবং শিকড় ও ছত্রাকের মাধ্যমে তারা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ইকোফিজিওলজিস্ট ও গ্লোবাল চেঞ্জ ইকোলজিস্ট উইলিয়াম হ্যামন্ড এবং নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ্যার অধ্যাপক ক্রেগ ডি অ্যালেন বিশ্বের বৃহত্তম গাছ এবং ঐতিহাসিক বনে ব্যাপক মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়েছেন। গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানীরা প্রাচীন গাছের জেনেটিক্স সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেছেন। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর বনের ভবিষ্যতে এ প্রাচীন বৃক্ষের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অনেকে জিনগতভাবে অক্ষত রেখে এসব প্রকাণ্ড বৃক্ষের ক্লোন তৈরি করে রোপণ করতে আগ্রহী। এটিকে দূরদর্শী পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা সে অনুযায়ী কাজও করছেন।
বন ও প্রাচীন বৃক্ষের প্রজাতি রক্ষায় ক্লোন প্রযুক্তিকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকে গ্রামীণ উত্তর মিশিগানে এক বাবা ও ছেলে মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রজাতির বৃহত্তম গাছ ক্লোন করার পরিকল্পনা করেন। ডেভিড মিলার্ক চতুর্থ প্রজন্মের কৃষক, যিনি বৃহৎ বৃক্ষের পরিচর্যা করেন। তিনি ও তার ছেলে জ্যারেড বড় গাছের তালিকা দেখে সেখানে যান এবং ওই জায়গার মালিকের অনুমতিক্রমে গাছের কিছু কাটিং সংগ্রহ করেন। কাটিংগুলো একটি নার্সারিতে পাঠানো হয়, যেখানে ওই বৃহৎ বৃক্ষের অবিকৃত কপি বা ক্লোন আকারে তা বড় হয়। এর পর মিলার্ক এবং তার ছেলে ক্লোনগুলো কবরস্থান, পার্ক বা কোনো খোলা জায়গায় রোপণ করেন। মিলার্ক একে ‘জীবন্ত আর্কাইভাল লাইব্রেরি’ বলে উল্লেখ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ৮০০, ২০০০ বা ৫০০০ বছরের পুরনো গাছের জেনেটিক্স সংরক্ষণ করতেই এ কাজ তারা শুরু করেন। মিলার্ক বলেন, ‘বৃহৎ বৃক্ষের জেনেটিক্স অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এদের জেনেটিক্স রক্ষা করতে ক্লোন করাটা ভীষণ জরুরি। এগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অনেকেই জানি না।’
মিলার্কের প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম গাছ ক্লোন করার এবং সারাবিশ্বে রোপণের এক অদ্ভুত প্রচেষ্টার গল্প তুলে ধরছে। প্রকল্পটি আমেরিকান ফরেস্ট নামে ওয়াশিংটন ডিসির একটি অলাভজনক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। এ প্রকল্পে মূলত রেডউডস ও সিকোইয়ার মতো আমেরিকার প্রাচীনতম, সবচেয়ে আইকনিক গাছগুলো ক্লোন করা হয়।
মিলার্কের সংগঠনটিকে এখন ‘আর্চঅ্যাঞ্জেল অ্যানসিয়েন্ট ট্রি আর্কাইভ’ বলা হয়। এখনও তারা গাছের ক্লোন করছে। তারা পুরনো বনেও বৃক্ষরোপণ করছে। মিলার্ক জানান, তারা প্রেসডিওতে ক্লোন করা ৭৫টি রেডউড রোপণ করেছেন। অন্তত ৪১টি শহরে সিকোইয়া রোপণ করেছেন। আর্চঅ্যাঞ্জেল অ্যানসিয়েন্ট ট্রি আর্কাইভের দর্শন হলো- ২০০০ বছরের পুরনো গাছগুলো নড়তে পারে না, তবে তাদের জেনেটিক্স তা করতে পারে। ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব এক নতুন বন।
যুক্তরাজ্যের কর্নওয়ালে ৪৯টি ক্লোন সিকোইয়া রোপণ করা হয়েছিল। সেগুলো ৩ ফুট উঁচু অবস্থায় এসেছিল, যা এখন প্রায় ১৫ ফুটের বেশি লম্বা। দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়াটা ওই প্রাচীন বৃক্ষের জিনগত বৈশিষ্ট্য। গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও ইলিনয়েসের মর্টন আরবোরেটাম সেন্টার ফর ট্রি সায়েন্সের পরিচালক চাক ক্যানন বলেন, ‘এই প্রাচীন গাছগুলোর মধ্যে থাকা জেনেটিক্সের বিশেষ সংমিশ্রণ শতাব্দীর সঙ্গে শতাব্দীর সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে পারে। এসব গাছে থাকা জিনগুলো চরম পরিবেশে চলার জন্য উপযোগী, যা শত শত বছর ধরে উপস্থিত ছিল না।’
দুই দশক ধরে ক্লোনিং চলার ওপর ২০২২ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখানে বলা হয়, প্রাচীন গাছগুলো আমূলভাবে জেনেটিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে এবং এভাবে পার্শ্ববর্তী বনের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিস্থাপকতা এবং এর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় অবদান রাখে।