
গাছেরাও কথা বলে। ছবি: সংগৃহীত
‘গাছেরাও কথা বলে’- শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই বক্তব্যের পেছনে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির গভীর রহস্য। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি যে কতটা জটিল ও সংবেদনশীল, তা আমরা প্রায়ই বুঝতে পারি না। গাছের জীবন কেবল নীরব-নিস্তেজ একটা অস্তিত্ব নয়, বরং এটি একটি সক্রিয় এবং আন্তঃসম্পর্কিত জগতের অংশ। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন যে গাছেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। তাদের এই বিস্ময়কর ক্ষমতা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
প্রথমে গাছের যোগাযোগ পদ্ধতি বোঝার জন্য আমাদের গাছের শিকড়ের দিকে নজর দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিকড়ের মাধ্যমে গাছেরা মাটির নিচে মাইকোরাইজাল ছত্রাকের একটি জাল তৈরি করে। এই জালকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় ‘উড ওয়াইড ওয়েব’। এই জালের মাধ্যমে গাছেরা পানি, পুষ্টি, এমনকি সংকেত
আদান-প্রদান করে। যখন কোনো গাছ আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তার শিকড় থেকে সংকেত পাঠানো হয় আশপাশের গাছগুলোর কাছে, যেন তারা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে।
গাছের পাতা থেকেও নির্গত হয় কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যা তাদের চারপাশের অন্য উদ্ভিদ এবং পোকামাকড়কে সংকেত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন গাছের ওপর কোনো শত্রু কীট আক্রমণ করে, তখন সেই গাছ তার নির্গত রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে পাশের গাছগুলোকে সতর্ক করে তোলে। ফলস্বরূপ, সতর্ক গাছগুলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
অন্যদিকে গাছের মধ্যে ইলেকট্রিক্যাল সংকেতও আদান-প্রদান হতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, গাছের অভ্যন্তরীণ কোষগুলোতে এক ধরনের ইলেকট্রিক চার্জের সঞ্চার ঘটে, যা সংকেত পাঠানোর একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। গাছের তন্তু দিয়ে এই সংকেত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে, যা গাছের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
গাছেরা কখনো কখনো বিশেষ সুগন্ধ নির্গত করে, যা তাদের প্রজাতির অন্য সদস্যদের নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গাছ তাদের শিকড়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যেটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে বা অন্য গাছের বংশবিস্তার বন্ধ করে দেয়।
গাছেরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ বই ‘দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিস’-এ এমন দাবি করা হয়। বইটির লেখক পিটার ওলেবেনের মতে, গাছ যে শুধু যোগাযোগ করতে সক্ষম তা নয়, এরা সামাজিক প্রাণীও বটে। এদের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক। এ ছাড়া ওলেবেন মনে করেন, গাছেরা ইলেকট্রিক সিগন্যাল ব্যবহার করে যোগাযোগ করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে, গল্প করে, এমনকি কোনো আঘাতপ্রাপ্ত গাছকে বছরের পর বছর বাঁচিয়েও রাখতে পারে।
এই প্রকৃতির নীরব বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে গাছেরা একটি সহযোগী পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি সদস্য টিকে থাকার জন্য একে অপরকে সাহায্য করে। এই সহযোগিতা আমাদের শেখায় যে প্রকৃতির প্রতিটি অংশই অন্যের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত।
এই অবিশ্বাস্য বৈশিষ্ট্যের কারণে আজকের দিনে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব আরো বেশি উপলব্ধি করা উচিত। গাছ কেবল অক্সিজেনের উৎস নয়, বরং তারা প্রকৃতির এক অনন্য সুরক্ষা বলয়, যা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের সুস্থতায় অবদান রাখে।
উপসংহারে গাছের এই নীরব বার্তা বিনিময় ও সহযোগিতামূলক আচরণ আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
দেয়- পৃথিবীর প্রতিটি জীবই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির এই দারুণ ভারসাম্য রক্ষা করতে আমাদের সচেতনতা ও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। গাছের এই জগৎ সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জানলে আমরা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও আরো দৃঢ় করতে পারি।