
শীতের অতিথি পাখি। ছবি: শামসুল হক
শীতের পদধ্বনি প্রকৃতিতে। শহরে শীত জাঁকিয়ে না বসলেও গ্রামে শীত অনুভূত হচ্ছে। সন্ধ্যার আকাশে ডানা মেলে আসতে শুরু করেছে শীতের পাখিরা। এসব পরিযায়ী পাখি শীতে আসে, গরমে চলে যায়। এ কারণে এদের আদর করে বলা হয় অতিথি পাখি। অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে হালকা শীতের আমেজ শুরু হতেই বাংলাদেশের বৃক্ষশোভিত উদ্যানের কাছাকাছি জলাশয়ে এসব পরিযায়ী পাখির আসা শুরু হয়। মাঘের শেষ পর্যন্ত থাকে তাদের এই পদচারণ। গাছপালায় ঢাকা সবুজ প্রকৃতি আর পাখির খাদ্য ও বসবাস উপযোগী জলাশয়গুলোও যেন বরণ করে নেয় অতিথি পাখিদের। তাই শীতকালে এই জলাশয়গুলোই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে অতিথি পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এদের কাছ থেকে দেখতে মানুষের ভিড়ও উপচে পড়ে। বিশেষত ছুটির দিনগুলোতে অতিথি পাখিদের দেখতে ছুটে আসে দর্শনার্থীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আগে দেশি-বিদেশি মিলে ১৯৫ প্রজাতির পাখির দেখা মিলত। তবে এখন বিদেশি প্রজাতির পাখির আসা কমে গেছে। এর প্রধান কারণ পাখি শিকার। পাখি যদি বুঝতে পারে জায়গাটি তাদের জন্য নিরাপদ নয়, তাহলে সেখানে আর আসে না। এভাবেই বহুপ্রজাতির পাখি এখন কালেভদ্রে দেখা যায়। তার পরও বেশকিছু পাখির প্রজাতি এখনো হরহামেশাই দেখা যায়। সাধারণত শীতের পুরোটা সময় জলময়ূর, ছোট সরালি, গার্গিনি, চিতা টুপি, বামুনিয়া, মুরহেন, খঞ্জনা, পিনটেইল, কোম্বডাক, পচার্ড, লাল গুড়গুটি, জলপিপি, শামুকভাঙা, নাকতা, মানিকজোড়, খোঁপাডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি প্রভৃতি পরিযায়ী পাখি ক্যাম্পাসের লেকে ও জঙ্গলে আসে।
ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়াও মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা আর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখিরা এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের জলাশয়গুলোই এদের পছন্দের স্থান, নিরাপদ আশ্রয়। বেশ কয়েক বছর ধরে নিঝুম দ্বীপ, দুবলার চর, কুতুবদিয়াতেও শীতের পাখিরা আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া তাদের বাসের উপযোগী এবং খাদ্যসংকট নেই বলেই পাখিরা আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে তাদের বাসের উপযোগী বলে মনে করে।
হাওর অঞ্চলে সকাল-দুপুর-বিকেলে পাখির ওড়াউড়ি আর জলকেলিতে মুগ্ধ হয় পর্যটকরা। পাখির কিচিরমিচির ডাকে ক্রমে মুখরিত হয়ে উঠছে এলাকাগুলো। শীতের তীব্রতা যত বাড়বে তত বেশি পাখি আসবে সারা দেশের হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল-পুকুরে। অনেক নদীতেও পাখিরা স্থান নেয়।
ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ার, সাইবেরিয়া কিংবা এন্টার্টিকার তীব্র শীত থেকে বাঁচতে দক্ষিণের কম শীতের দেশে যায় পাখিরা। এ সময় শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেরও প্রচুর অভাব থাকে। শীতপ্রধান এলাকায় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সঙ্গে রয়েছে তুষারপাত। সংকুল পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বিশাল পথ ছোট্ট ডানায় পাড়ি দিয়ে এসব পাখি চলে আসে নাতিশীতোষ্ণ ম-লের এলাকাÑআমাদের দেশে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব পাখি তাদের গন্তব্যস্থান ঠিকভাবেই নির্ণয় করতে পারে। এখানে আসতে তাদের পাড়ি দিতে হয় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ। বহু পথ পেরিয়ে তারা খুঁজে নেয় তাদের পছন্দনীয় নির্জন স্থান, জলাশয় নতুবা বনজঙ্গল। তাদের দল বেঁধে ছুটে চলা সবার দৃষ্টি কাড়ে।
দল বেঁধে আসা এসব পরিযায়ী পাখি মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতিকে ভরিয়ে রাখে। গ্রীষ্মকালে সুমেরুতে থাকে এবং বাচ্চা দেয় হাঁসজাতীয় এমন পাখি, শীতকালে বাংলাদেশে আসে। লাল বুকের ক্লাইক্যাসার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। অন্য পাখিরা আসে পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে। বাংলাদেশের অতি পরিচিত অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল। এ ছাড়া রয়েছে স্বচ্ছ পানির খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস, বড় সারস, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড ও বিলুপ্তপ্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া)। এ ছাড়া নানা রং আর কণ্ঠবৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস ও লেঞ্জাই প্রধান। তবে আরো অনেক প্রজাতির পাখি এখনো আসে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অতিথি হয়ে আসা এই পাখিগুলো থাকতে পারছে না। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, এক দশক আগেও এ দেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসত। এ সংখ্যা প্রতি বছরই হ্রাস পাচ্ছে। একশ্রেণির শিকারির হাতে তারা শিকার হয়, পরিণত হয় খাবারের থালায় মচমচে স্বাদের খাবারে। আমাদের আতিথেয়তায় যেখানে পাখিদের নিরাপদে দিন পার করার কথা, সেখানে তাদের জীবন নিয়ে স্বদেশে ফেরা হয়ে গেছে শঙ্কার।
আমাদের দেশে বাঁচার জন্য যেসব পাখি বেড়াতে আসে তারা আমাদের অতিথি। তাদের লালন করা মানেই প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করা। অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করতে সরকারি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রুখে দিতে হবে সব পাখি শিকারিকে। তাহলে রক্ষা পাবে অতিথিসহ স্থানীয় পাখিরা। রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য আর পরিবেশ ভারসাম্য।