
প্লাস্টিক ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রকৃতিকে। ছবি: সংগৃহীত
প্লাস্টিক আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রকৃতিকে। প্লাস্টিক ও পলিথিন সহজে পচে না। নষ্ট হতে সময় লাগে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ বছর, যা ধীরে ধীরে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ন্যানোপ্লাস্টিকে, যা আরো মারাত্মক।
দেশে প্রতিদিন ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ১৩৯ টন প্লাস্টিক দূষণ নদীর মাধ্যমে সাগরে মিশে যায়। জানা যায়, এক হাজার ৬৫৬টি নদীর মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য দ্বারা সাগর দূষণের ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে। ২০৬০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ প্রায় তিন গুণ হতে পারে। যার পরিমাণ ১ দশমিক শূন্য বিলিয়ন টন হতে পারে।
এ সমস্যা সমাধানে অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। আবিষ্কার করেছেন বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল প্লাস্টিক। সাধারণ প্লাস্টিকের সঙ্গে এর বেশ কিছু পার্থক্য আছে।
বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক কী
এটি এমন এক ধরনের প্লাস্টিক, যা প্রাকৃতিকভাবে মাইক্রো-অর্গানিজম (যেমনÑব্যাকটেরিয়া বা ফাংগি) দ্বারা ভেঙে যায়। এটি নবায়নযোগ্য উপকরণ থেকে তৈরি। যেসব পলিমার সূর্যের আলো এবং প্রাকৃতিকভাবে ব্যাকটেরিয়া জীবাণু দ্বারা বিয়োজিত হতে পারে তাদের বায়োডিগ্রেডেবল পদার্থ বলা হয়। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পলিমারের একটি বিশেষ শ্রেণি, যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল দ্বারা প্রকৃতির মধ্যে পুনরাবর্তিত হয়ে বা পচন প্রক্রিয়া দ্বারা ভেঙে যায়। বায়োডিগ্রেডেবল পলিমারে এস্টার, অ্যামাইড বা ইথার বন্ড থাকে। কিছু বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক কম্পোজটেবল অর্থাৎ এই ধরনের প্লাস্টিকগুলো কিছু নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে বিলীন হয়ে যায়। এটি প্রচলিত প্লাস্টিকের তুলনায় পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ প্লাস্টিকের মতো শত শত বছর ধরে টিকে না থেকে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক তুলনামূলক দ্রুত মাটিতে মিশে যায়।
প্রকৃতিতে কীভাবে কাজ করে
বায়োডিগ্রেডেবল পলিমারগুলো তাদের কাঠামো এবং সংশ্লেষণের ভিত্তিতে দুটি গ্রুপে বিভক্ত। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি হলো কৃষি-পলিমার বা জৈববস্তু থেকে প্রাপ্ত। অন্যটি বায়োপলিইস্টার, যা অণুজীব থেকে প্রাপ্ত বা সিনথেটিকভাবে প্রাকৃতিক বা সিনথেটিক মনোমার থেকে তৈরি। বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল প্লাস্টিকে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক মেশানো থাকে। বিশেষ এই রাসায়নিক মূলত দুইভাবে কাজ করে। এক. সরাসরি বিশেষ কিছু অণুজীবকে আকৃষ্ট করে। দুই. পরিবেশে প্লাস্টিকের স্বাভাবিক ক্ষয় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এ ক্ষেত্রেও অণুজীবই প্লাস্টিককে ভাঙে, তবে এ জন্য তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। এই দুই প্রক্রিয়াতেই বিশেষ কিছু অণুজীব এ ধরনের প্লাস্টিক গ্রহণ করে খাদ্য হিসেবে।
এসব অণুজীবের দেহের এনজাইমের প্রভাবে প্লাস্টিকের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে যায়। বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন পরিবেশদূষণ হ্রাস করে এবং পরিবেশ সুরক্ষাব্যবস্থা কাঠামোকে সহায়তা করে। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, পানি জৈববস্তু এবং অজৈব লবণের মতো প্রাকৃতিক উপজাতগুলো পাওয়া যায়। তবে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পচনের জন্য বিশেষ পরিবেশ প্রয়োজন। সাধারণত ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রায় পর্যাপ্ত আর্দ্রতা, বাতাস ও অণুজীবের উপস্থিতি ছাড়া এগুলো পচে না। অর্থাৎ সাগরে বা বাসাবাড়ির আবর্জনার মধ্যে এসব প্লাস্টিক সাধারণ প্লাস্টিকের মতোই অক্ষত থাকে।
বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহারের সুবিধা
বায়োডিগ্রেডেবল সাধারণ প্লাস্টিকের তুলনায় দ্রুত পচে যেতে সক্ষম। সঠিক পরিস্থিতি থাকলে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক মাটিতে বা কম্পোস্টে মিশে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি কমায়। কিছু বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক বায়োভিত্তিক উপাদান (যেমন- কর্ন স্টার্চ বা পাট) থেকে তৈরি, যা পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব। উৎপাদন ও ব্যবহারে কার্বন নিঃসরণ তুলনামূলক কম হয়।
সীমাবদ্ধতা
বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এটি সঠিক তাপমাত্রা (সাধারণত ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি), আর্দ্রতা ও অণুজীবের উপস্থিতি ছাড়া পচে না। তাই এটি উপযুক্ত পরিবেশ ছাড়া সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে সব সময় পচবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কিছু বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পুরোপুরি পচে না গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হতে পারে, যা পরিবেশের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর। এ ছাড়া প্রচলিত প্লাস্টিকের তুলনায় বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকের উৎপাদন খরচ বেশি। এটি অন্যান্য প্লাস্টিকের সঙ্গে মিশ্রিত হলে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সঠিক সমাধান কী?
বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক এককভাবে সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান নয়। এটি মন্দের ভালো হিসেবে বিকল্প হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য প্রয়োজন রিসাইক্লিং ব্যবস্থার উন্নয়ন। পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং নবায়নযোগ্য পণ্যের প্রসার। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরো উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিবেশবান্ধব ও বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পণ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সাহায্য করছে। বিশেষ করে পাট থেকে তৈরি ‘সোনালি ব্যাগ’ একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। সোনালি ব্যাগের আবিষ্কার করেন মোবারক আহমদ খান। এটি সম্পূর্ণরূপে বায়োডিগ্রেডেবল এবং সহজে মাটিতে মিশে যায়, যা পরিবেশের জন্য বেশ উপকারী। এটি প্লাস্টিকের চমৎকার বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক আসলে মন্দের ভালো। প্লাস্টিকের তুলনায় কিয়দংশ পরিবেশের জন্য ভালো। কিন্তু একেবারে নিরাপদ দাবি করার সুযোগ নেই। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহার সঠিক পরিস্থিতিতে পরিবেশবান্ধব হতে পারে, তবে এটি প্লাস্টিকদূষণের একমাত্র সমাধান নয়।