
মক্কার প্রধান প্যাগান দেবতার মূর্তি। ছবি: সংগৃহীত
প্রাচীন আরবের সমাজ ছিল একাধিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও পূজা-আচারব্যবস্থায় পরিপূর্ণ। মক্কা, যা পরবর্তী সময়ে ইসলামের পবিত্রতম শহর হয়ে ওঠে, একসময় ছিল প্যাগান ধর্মীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। এখানে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি ও প্রতিমা পূজিত হতো এবং এই পূজাগুলো ছিল আরবীয় সমাজের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মক্কার প্রধান প্যাগান দেবতা হিসেবে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করা হুবাল ছিল একটি শক্তিশালী আকাশ দেবতা, যাকে মক্কার মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, যেমন- বৃষ্টি, শস্য, বিজয় ও সৌভাগ্য কামনার জন্য পূজা করত।
কাবা ঘরের ভেতরে তার মূর্তি ছিল, যা ছিল প্যাগান ধর্মবিশ্বাসী আরবদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান। তবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর হুবাল ও অন্য দেবতাদের মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং কাবা ঘরের পবিত্রতা মুসলিমদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও ইতিহাসের এই অধ্যায় আলোচিত হয়, যা প্রাচীন আরব সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হুবালের দেবত্ব, তার পূজা এবং মূর্তির অবস্থান কাবার ভেতরে, প্রাচীন মক্কার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল এবং এটি ইসলাম-পূর্ববর্তী আরব সমাজের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
হুবাল : দেবতার পরিচিতি
হুবাল সাধারণত একটি বড়, কাঠের মূর্তি হিসেবে পূজিত হতো, যা কাবা ঘরের ভেতরে রাখা হয়েছিল। তাকে এক প্রকার আকাশ দেবতা হিসেবে ভাবা হতো এবং বিভিন্ন ধরনের জীবিকা ও সমস্যার সমাধান চেয়ে তার কাছে প্রার্থনা করা হতো। মক্কাবাসী বিশ্বাস করত, হুবাল তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। বিশেষত বৃষ্টি, শস্য এবং যুদ্ধের বিষয়ে। হুবাল মূলত আরবি প্যাগানিজমের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে তার প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মূর্তির অবস্থান ও পূজা
হুবালের মূর্তি কাবাগৃহে রাখা ছিল, যা ছিল একটি পবিত্র স্থান এবং প্রাচীন মক্কায় সেখানে পূজার্চনা অনুষ্ঠিত হতো। মক্কার কারবালার মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে গড়ে ওঠা একাধিক মূর্তি ও প্রতিমা ছিল, যেগুলো বিভিন্ন দেবতার প্রতি পূজা ও শ্রদ্ধার প্রতীক ছিল। হুবাল একমাত্র দেবতা ছিলেন না, বরং তার সঙ্গে অন্যান্য দেবতাও পূজিত হতো, যেমন : লাত, উজ্জা ও মানাত। তবে হুবালকে মক্কার প্রধান দেবতা হিসেবে বিশেষ শ্রদ্ধা দেওয়া হতো এবং তার মূর্তির উপাসনা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
হুবাল ও তার ভূমিকা
হুবাল ছিল প্যাগান ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তার পূজা মুসলিম যুগের আগেও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। বিশেষত, হুবালের মূর্তির কাছে নানা ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী এবং ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য পুরোহিতরা শরীরের কোনো অংশের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য সিদ্ধান্ত নিতেন। এটি ছিল একটি প্রাচীন রীতির অংশ, যা ইসলামের আগের যুগে প্রচলিত ছিল। হুবালের সঙ্গে একটি বিশেষ রীতিও জড়িত ছিল, তা হলো ‘হুবালের তাস’ বা ভাগ্য পরীক্ষা। মক্কাবাসী ভাগ্য নির্ধারণের জন্য তাস (বাহুবল) ব্যবহার করতেন। এটি একটি বিশেষ ধরনের পাথরের টুকরা বা কাঠের চিহ্ন, যা ভাগ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করত। হুবালের পূজার সময় এই তাস ব্যবহার করে ভাগ্য পরীক্ষা করা হতো, যা তখনকার সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার ছিল।
হুবালের পেছনে ইতিহাস ও বিশ্বাস
হুবাল দেবতার পূজার শুরুর ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা না গেলেও এটি পুরোনো আরব ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ধারণা করা হয়, হুবাল একজন প্রাচীন কনানান দেবতা, যার পূজা আরবীয় জনগণের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলছিল। প্রাচীন আরবের বিভিন্ন গোত্র এই দেবতার পূজা করত এবং তাকে আকাশ ও ভাগ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করত। কাবাগৃহের ভেতর হুবালের মূর্তি ছিল এবং অন্য দেবতাদের প্রতিমা ও মূর্তির সঙ্গেও তার পূজা সম্পন্ন হতো।
ইসলামের প্রভাব
ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর প্রথাগত প্যাগান দেবতাদের পূজা এবং মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ করা হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তার অনুসারীরা মক্কা থেকে প্যাগান দেবতাদের উৎখাত করে এবং একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে হুবালের পূজা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয় এবং কাবার পবিত্রতা মুসলিমদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ইসলামের ইতিহাসে হুবাল আর কোনো স্থান পায়নি, তবে তার প্রভাব ও পূজার ইতিহাস আজও আলোচিত।