
বাংলাদেশের বনাঞ্চলে একের পর এক হাতি হত্যার ঘটনা ঘটছে। ছবি: সমির মল্লিক
গত ৬ জানুয়ারি কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারীর বিচাইন্নারছড়া এলাকায় হাতির আক্রমণে এক কৃষক নিহত হন। তবে এর পেছনের ঘটনাটি মোটেই সরল নয়। ওই কৃষক তামাক ক্ষেতে বৈদ্যুতিক তার পেতে রেখেছিলেন। তাতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা পড়ে একটি অন্তঃসত্ত্বা হাতি। রাত ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। রাতেই ওই কৃষককে মেরে ফেলে নিহত মাদি হাতি দলের একটি ক্ষুব্ধ পুরুষ হাতি।
এর ছয় দিন পর ১২ জানুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের (লামার একই নামের ইউনিয়নের পাশেই অবস্থিত) ঘুনিয়া এলাকায় পাহাড়ের পাশের তামাক ক্ষেত থেকে একটি বুনো হাতির লাশ উদ্ধার করে বন বিভাগ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, এর মৃত্যুর কারণও তামাক ক্ষেতের বিদ্যুতের ফাঁদ।
সেই ২০০৯ সালের দিকে প্রথম যখন লামা-আলীকদমে যাই তখনই উপজেলা দুটিতে প্রচুর তামাক ক্ষেত দেখেছি। এখন কক্সবাজারের চকরিয়া এবং বান্দরবানের লামা, আলীকদমের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তামাক ক্ষেত। পাহাড়ি এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণ থেকে তামাক ক্ষেত ও ফসল রক্ষায় বৈদ্যুতিক ফাঁদ ব্যবহার করেন কৃষকরা। এ ধরনের ফাঁদে পড়ে মারা পড়ছে একের পর এক হাতি।
বিশ্বে চার লাখের বেশি আফ্রিকান হাতি থাকলেও এশীয় বুনো হাতি আছে ৫০ হাজারের কম। ১০০ বছর আগেও এ সংখ্যা দ্বিগুণ ছিল। যে ১৩টি দেশে এশীয় হাতি আছে, সেগুলো হলো ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, চীন, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপাল। এগুলোর মধ্যে নেপাল ও ভিয়েতনাম ছাড়া বাকি ১১ দেশেরই বুনো হাতির সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি।
একসময় বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই হাতির দেখা মিললেও এখন স্থায়ী বুনো হাতি আছে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে।
আমাদের অতি পরিচিত সাজেক, রেমাক্রি কিংবা মদকের মতো জায়গাগুলোতেও একসময় বুনো হাতির বিচরণ ছিল। এমনকি রেমাক্রির আশপাশের এলাকায় গত শতকের মাঝামাঝিতেও খ্যাপা হাতির ভয়ে মুরংরা গাছের ওপর মাচা বেঁধে বাস করার রেকর্ড আছে। কাসালং সংরক্ষিত বনে গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ১০০ বুনো হাতির পাল থাকার কথাও শোনা যায়। আর এখন গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে (লামা-আলীকদম বাদ দিলে) সাকুল্যে স্থায়ী বুনো হাতির সংখ্যা ৫০-এর কিছু বেশি।
একটা সময় পর্যন্ত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম এলাকায় বুনো হাতি তুলনামূলক ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা আসার পর হাতি চলাচলের পথ আটকে গিয়ে একাধিক পাল বন্দি, বিদ্যুতের ফাঁদ এবং গুলি করে একের পর এক হাতি হত্যা এই অঞ্চলের হাতিদেরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়া ও আহত হওয়া, বাড়িঘর ধ্বংস এবং ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়ার পেছনে একচেটিয়া হাতিদের দোষ দেওয়া হয়। বাস্তব সত্য হলো আমরা মানুষেরা হাতিদের বিচরণ এলাকায় ঘর বানিয়েছি, চাষ করেছি আর পাহাড়ের গাছপালা কেটে ন্যাড়া করে দিয়েছি। হাতির জন্য সর্বশেষ বিপদ হয়ে এসেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। সংরক্ষণ ব্যবস্থা অনেক ভালো হওয়ার পরও ভারতে গত ১০ বছরে ২০০ বুনো হাতি ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের দেশে ট্রেনের ধাক্কায় প্রথম বন্য হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে গত বছরের ১৫ অক্টোবর। ইদানীং চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে একের পর এক হাতি মৃত্যুর যে ঘটনা ঘটছে তার প্রায় সব দুর্ঘটনাই কক্সবাজার-লামার বন-পাহাড়ে। এই দুর্ঘটনার অনেকটাই সুপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে হত্যা করেছি আমরা মানুষরাই। ভাবছেন অন্য জায়গায় তাহলে হাতিরা ভালো আছে। মোটেই না, ওই সব অরণ্যে হাতির অবস্থা আগে থেকেই খারাপ।
‘বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট’ (বিএনসিএ) ২০২২ সালে জানিয়েছে, বনাঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ২০০টি বুনো হাতি আছে। অথচ ড. রেজা খান ১৯৮৩ সালে বনগুলোতে ৪০০টির মতো স্থায়ী বন্য হাতি পেয়েছিলেন সার্ভে করে।
অথচ আগে হাতিরা কী সুন্দর দিন কাটাত। ইউসুফ এস আহমেদ, এনায়েত মাওলার বই থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় বিংশ শতকের মাঝামাঝির দিকে কাসালং, কাপ্তাই- এসব জায়গায় ঘটা করে খেদার আয়োজন হতো। একেকটা খেদায় ৩০ থেকে ৪০টি ধরা পড়ত। বুঝুন ওই সব জঙ্গলে কত্ত হাতি ঘুরে বেড়াত তখন! বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেড় দশকে মানুষের আক্রমণসহ নানাভাবে মৃত্যু হয়েছে ১১৫টি হাতির। একই সময়ে হাতির আক্রমণে মারা গেছে ২৯২ জন মানুষ।
ভাবছেন হাতি মারা গেলে আর এমন কী? এরা তো আর মানুষ নয়। কিন্তু আমরা মানুষরা যেমন কেউ মারা গেলে দুঃখ পাই, শোক প্রকাশ করি, হাতিরাও তাই করে। শুঁড় দিয়ে কখনো মৃত সঙ্গীর শরীরটা ছুঁয়ে দেখে ওরা। কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে শোক করে। এমনকি হাতিদের মধ্যে কেউ মারা গেলে অন্য হাতিরা সঙ্গীর দেহটা কবর দেওয়ার চেষ্টাও করে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একবার দুর্দান্ত একটি ভিডিও করেছিল। সেখানে দেখা যায়, একটি মেয়ে হাতি মৃত সঙ্গীর দাঁত শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে অনেক মমতায়। এভাবে সে থাকে কয়েক ঘণ্টা।
আপনি হয়তো ভাবছেন হাতিরা জঙ্গলে থাকলেই পারে? তাদের লোকালয়ে আসার দরকার কী? জঙ্গলেও যে এখন মানুষের বসতি। তা ছাড়া বনের গাছপালা কেটে বিশাল জন্তুটার খাবার জন্য তেমন কিছু রাখিনি আমরা। আবার এখন যেসব জায়গায় মানুষের বসতি, ধানক্ষেত- এসব এলাকাতেও এক সময় ছিল হাতিদের আস্তানা। ওদের এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে যাওয়ার পথও আমরা আটকে দিয়েছি নানা স্থাপনা তুলে। তাহলে হাতিরা যাবে কোথায়?
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। হাতির খোঁজে চষে বেড়িয়েছি রাঙামাটির কাপ্তাই, বান্দরবানের লামা-আলীকদম, দুধুপুকুরিয়াসহ কত জঙ্গলে। কাসালং ফরেস্টের রাঙ্গীপাড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম হাতির পালের ১০ গজের মধ্যে। তখন হাতিগুলো মানুষের যন্ত্রণায় ছিল খুব অস্থির, তার পরও আমাকে কিছুই করেনি। এখন আবার পুরোনো সেই প্রশ্নটাই ঘুরেফিরে আসছে, সত্যি কী বুনো হাতিদের জন্য আর জায়গা নেই আমাদের বনে?
একসময় সিলেট বিভাগের বিস্তৃত এলাকায় চরে বেড়াত বুনো হাতিদের পাল। এমনকি গত শতকের মাঝামাঝি এবং তার পরও হাতিদের এত খারাপ অবস্থা ছিল না। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন বনেই বুনো হাতির বিচরণ ছিল। সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের বনে গাছপালা কমে যাওয়া ও সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার কারণে এখন লাঠিটিলা ছাড়া সিলেটের কোথাও বন্য হাতির চলাচলের খবর শোনা যায় না বললেই চলে। লাঠিটিলা-করিমগঞ্জের অরণ্যে ঘুরে বেড়ানো হাতির সংখ্যা এখন মোটে চার। এই চারটিই মাদি হওয়ায় প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির আর সুযোগ নেই।
ময়মনসিংহ বিভাগের গারো পাহাড় পাদদেশের শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার হাতিগুলোও আছে ভীষণ বিপদে। এই এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে বিচরণ শখানেক হাতির। এখানে হাতির খাবার এবং আবাসস্থল দুটোরই প্রবল সংকট। তাই নিয়মিতই হাতির আক্রমণে মানুষ এবং মানুষের পেতে রাখা বিদ্যুতের ফাঁদে মারা পড়ছে হাতি।
আমার একটা ভয়, এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো বাঘের আগেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বুনো হাতি। তখন কেবল রূপকথার গল্পেই ওদের কথা পড়বে আমাদের শিশুরা।
কীভাবে আমরা হাতি বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করতে পারি তা জানতে চেয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক মনিরুল খানের কাছে। এই বন্যপ্রাণী গবেষক বলেন, ‘হাতির মূল আবাসস্থলগুলো চিহ্নিত করে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা জরুরি। বিশেষ করে গারো পাহাড় এলাকায় অভয়ারণ্য নেই। সেখানে হাতির জন্য অভয়ারণ্য জরুরি। এ ছাড়া হাতির আবাসস্থলের উন্নয়ন, ব্যাপক জনসচেতনতা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগের বিকল্প নেই।
আমাদের অনেকেরই ধারণা, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার শুধু মানুষেরই আছে। আমরা যদি এটা স্বীকার করে নেই এখানকার মাটি, আলো-বাতাস, গাছপালার ওপর হাতিদেরও অধিকার আছে, তাহলে হয়তো তাদের বাঁচানো সম্ভব হলেও হতে পারে।