
পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নীলডুমুর খেয়াঘাট হতে আমরা দক্ষিণ বেদকাশীর উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। কিন্তু চলতি পথে দ্বীপ-ইউনিয়ন গাবুরার পারে নামি। গাবুরা বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের এক জনপদ। এর চারদিক নদী দিয়ে ঘেরা; যার তিন দিকে নদীপারে বসতি হলেও একদিকে সুন্দরবন।
পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বাদাবন। বিশ্বের আরো অনেক দেশে ম্যানগ্রোভ বন আছে, তবে আমাদের মতো একক আয়তনের এ রকম বন আর কোথাও নেই। নদীর পারে বাঁধ ভাঙছিল, দেখেই বোঝা যায়। কিছুদিন আগে এখানে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে ভাঙনের হাত থেকে বাঁধ রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পারে গিয়ে একটি দোকানে অনেক মানুষের জটলা দেখে সেখানেই বসি। মানুষগুলো সকাল বেলায় দোকানে বসে গল্প জুড়েছিল। কথা শুরু করি সুন্দরবন কেমন আছে, আপনারাই বা কেমন আছেন, জানতে চেয়ে?
একজন আরেকজনের মুখের দিকে ইতিউতি তাকান। অনুধাবনের চেষ্টা করছেন আমরা কারা। নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলি, আমরা সাংবাদিক, আপনাদের সঙ্গে বনের কথা জানতে এসেছি। তারা নড়েচড়ে বসেন। রোদে পোড়া তামাটে বর্ণের এক ত্রিশোর্ধ যুবক শুরুতে উত্তর দেন, বলেন, ‘বাদা করেই (বনে গিয়ে) আমাইগে জীবন চলে। মাছ-কাঁকড়া ধরার জীবন। তাতে যে আয় হয়, তাতেই কোনো মতে জীবন চলে। কিন্তু এবারে বাদায় যাওয়া কঠিন হইয়ে গেছে। দস্যুগে বেজায় উৎপাত। এই কয়দিন আগে আমারে ধইরে তেরো দিন আইটকে রাহিল। জন্মের খাটাইছে; রাতেবিরেতে নৌকা বাইতি হইছে। পরে চার হাজার টাহা দিয়ে ছাড়া পাইসি।’
সেখানে বসা ছিলেন ১১ জন। তারা সবাই বনে যান। ওই দোকানদার তাদের মহাজন। বনে গেলে পরিবারের বাকি সদস্যদের খাবারের ব্যবস্থা করে যেতে হয়। নৌকা, জালও জোগাড় করতে হয়। এসবের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ওই মহাজনই সরবরাহ করেন। কারো কারো নিজেদের নৌকাও আছে। এরা সাধারণত সাত দিনের পাস (বন বিভাগের অনুমতিপত্র) নিয়ে বনে যান। সেখানে গিয়ে তারা কাঁকড়া ধরেন, মাছ ধরেন। বসতি এলাকায় কাঁকড়া চাষ (খাঁচায় পুরে খাবার খাইয়ে মোটাতাজাকরণ) জনপ্রিয় হওয়ায় ছোট কাঁকড়ার চাহিদা বেশি, যা একমাত্র সুন্দরবনেই পাওয়া যায়। কৃত্রিমভাবে অর্থাৎ হ্যাচারিতে কাঁকড়া উৎপাদন করা এখনো সম্ভব হয়নি। যে যুবকটি কথা বলছিলেন, সেই যুবকের পিতাও ততক্ষণে সেখানে হাজির হয়েছেন। তারা বাপ-বেটা দুজনেই বনে যান।
এই বনজীবীরা আর কয়েক দিন পরে মধু সংগ্রহে যাবেন। মধু সংগ্রহের মৌসুম দুই মাস- এপ্রিল ও মে। এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে মধু সংগ্রহের পাস দেওয়া হয়। বছরের বাকি সময়ে তারা মাছ, কাঁকড়া ধরেন। কিন্তু মাছ আর আগের মতো পাওয়া যায় না। একসময় বিপুল পরিমাণে চিংড়ি পোনা আহরণ করা হতো, পাওয়াও যেত। চিংড়ি পোনা আহরণের জন্যে বিশেষ জালে আরো অন্যান্য মাছের পোনা উঠত; শুধু চিংড়ি পোনা রেখে বাকি পোনা ফেলে দেওয়ায় এবং বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় এখন সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছের পরিমাণ কমেছে। অনেকেই এখন মাছ আহরণের জন্য বিষ প্রয়োগ করেন। খালের পানিতে বিষ ছড়িয়ে দিলে মাছ ভেসে ওঠে। তাদের দাবি, এই বিষে ক্ষতি হয় না। এই বিষ ফলের পোকা দমনের জন্যে দেওয়া হয়। সেই ফল মানুষ অহরহ খাচ্ছে।
বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বনজীবী এই মানুষের বেশির ভাগেরই নিজের জমি নেই। কেউ কেউ বাঁধের কাছে সরকারের জমিতে (খাসজমি), কেউ কেউ অন্যের জমিতে বসবাস করেন। কারো কারো অতীতে জমি ছিল। এরা সুন্দরবন নিয়ে অনেক ভাবেন, বন টিকিয়ে রাখতে হবে, তাও বোঝেন; কারণ এটাই তাদের জীবিকার উৎস।
বিশ্বের সবচেয়ে একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, যা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে মোট আয়তন ১০ হাজার ২৩০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ছয় হাজার ৩০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে। এই বনাঞ্চল এখন প্রাকৃতিক ও মুনষ্যসৃষ্ট উভয় ঝুঁকিতে পড়েছে। ঝড়ঝঞ্ঝা ছাড়াও সুমদ্রের পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং নদ-নদীতে বিপুল পরিমাণে পলি অবক্ষেপনের ফলে নদী শুকিয়ে বা মরে যাচ্ছে। অন্যদিকে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবসাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ সুন্দরবন এখন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় চাপেই পিষ্ট।
বলা হয়, সুন্দরবনে ছোট-বড় তিন শতাধিক নদ-নদী রয়েছে। বাংলাদেশ অংশের অন্যতম প্রধান দুটো নদী শিবসা ও পশুর। অত্যধিক পলি জমা হওয়ার কারণে এক সময়কার গভীর ও ভয়ংকর শিবসার এক অংশ শুকিয়ে গেছে। অন্যান্য নদ-নদীর বুকেও পলি জমা হচ্ছে। মোংলা বন্দরের প্রধান চ্যানেল পশুর নদও সুন্দরবনের মধ্যে। পশুর চ্যানেলটি উত্তরে মোংলা বন্দর এলাকা থেকে দক্ষিণে হিরণ পয়েন্ট পর্যন্ত বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। পলি জমে এটির স্থানে স্থানে চরা পড়েছে। প্রায় মোহনার কাছে হিরণ পয়েন্টে, দুবলা ও তিনকোনা দ্বীপের কাছে পলি জমে চরা পড়েছে। ভাটার সময় এসব জায়গায় ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকাও আটকে যায়। অতি সাবধানে গভীরতা নির্দেশক সীমানা দেখে কিছু জাহাজ বনের মধ্যে বন্দরের হারবারিয়া পয়েন্টে আসে, কিছু জেটি এলাকায় আসে। আবার আসা-যাওয়ার সময় ছোট-বড় জাহাজগুলো তাদের বর্জ্য সুন্দরবন এলাকায় ফেলে যায়।
পলি জমে নদী ভরাট হচ্ছে; তা এত পলি কোথা থেকে, কীভাবে আসে? প্রকৃতপক্ষে উত্তরের নদীগুলোয় বয়ে আনা বিপুল পরিমাণে পলি, যা মেঘনা মোহনা দিয়ে সাগরে গিয়ে পতিত হয়; তারই কিছু পরিমাণ পলি জোয়ারের পানিতে মিশে চলে আসে সুন্দরবন ও সংলগ্ন উত্তরের নদ-নদীতে। আগে নদ-নদী ও খাল-নালা হয়ে ওই পলি প্লাবনভূমিতে অবক্ষেপিত হতো; কিন্তু উনিশশ ষাটের দশকে জলোচ্ছ্বাস ও নোনা রুখতে পোল্ডার ব্যবস্থার মাধ্যমে মাটি দিয়ে শক্ত ও উঁচু বাঁধ এবং প্লাবনভূমির পানি নিষ্কাষণের জন্য স্লুইস গেট তৈরি করা হয়। জোয়ারের পানিতে আসা পলি ওই স্লুইস গেটের মুখে আটকে তা আর প্লাবনভূমিতে যেতে পারে না, তাই নদীগর্ভে জমা হয়ে নদী শুকাচ্ছে, মরছে।
সাম্প্রতিককালে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবসাও বেড়েছে। কিন্তু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের এই বনটির বিশেষত্ব বিবেচনায় রেখে পর্যটনের বিধি-নিষেধ অনুসরণ করা হয় না। বিশেষত পর্যটকদের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী- পানির বোতল, খাবারের পাত্র, অপ্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী বনের যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া হয়। গত মাসের (ফেব্রুয়ারি) শেষের দিকে এই প্রতিবেদকও বনের পূর্বদিকের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে সাগরঘেঁষা ‘ডিমের চর’-এ পর্যটকদের ফেলে যাওয়া সামগ্রী দেখেছে। সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া, কলাগাছিয়া, হিরণপয়েন্ট, কটকা, কচিখালি
প্রভৃতি এলাকায় পর্যটকরা নির্দিষ্ট এলাকায় হাঁটাচলা করতে পারেন। আছে বনের মধ্যেই ইট-পাথর-লোহায় তৈরি করা কৃত্রিম পথ। এসব কেন্দ্রকে বন বিভাগ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র বলছে। আরো আছে রাতের বেলায় লঞ্চগুলোর তীব্র আলোর ঝলকানি।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই সুন্দরবন। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নেয় এই বনভূমি। এতে পরিবেশের দূষণ কমে। কার্বন ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে নোনাজলের এই উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। অথচ বাড়তি নোনাই তাদের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে; আর বনজীবীরা যারা বনজ সম্পদ আহরণের মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা দস্যুদের ভয়ে সিটিয়ে আছে। তাদের শ্রম ও সময় দিয়ে প্রকৃতির বুক থেকে আহরিত সম্পদ তুলে দিতে হয় পরজীবী ক্ষমতাধরদের হাতে, হায়!