
কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী। ছবি: সংগৃহীত
কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী- এ কথা আমরা সবাই জানি। আদিমযুগে মানুষ যখন গুহায় থাকত, শিকার করে খাবার সংগ্রহ করত, তখন থেকেই এই বন্ধুত্বের শুরু। কুকুর মানুষকে সাহায্য করত, সঙ্গ দিত, আবার শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষাও করত। কুকুর হচ্ছে প্রথম প্রাণী, যাকে মানুষ পোষ মানায়। বন্ধুসুলভ প্রভুভক্ত এমনই এক কুকুরের অবাক করা সত্যি গল্প শোনাব আজ।
সময়টা ১৯২৪ সালের মাঝামাঝি। আর সব দিনের মতোই বাড়ি ফিরছিলেন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিদেসাবুরো উনো। ফেরার পথে হঠাৎ ছোট্ট একটা কুকুরের বাচ্চাকে অসহায়ের মতো হাঁটতে দেখে ভারি মায়া হয় তার। আশপাশে অনেকক্ষণ খুঁজেও কুকুরের মালিককে পাননি তিনি। চলে আসতে চাইলে কুকুরটাও পিছু নেয় তার। অগত্যা কুকুরের বাচ্চাটিকে নিয়েই বাড়ি ফেরেন তিনি।
প্রফেসরের স্ত্রী মোটেই সহ্য করতে পারতেন না কুকুর। তাই তিনি কুকুরটাকে লুকিয়ে রাখেন ঘরের বাইরে আরেকটি স্থানে। কিছুদিন পরেই স্ত্রীর হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। কিন্তু কুকুর ছানাটির প্রতি অধ্যাপকের ভালোবাসা দেখে একসময় স্ত্রীও মেনে নেন কুকুরটিকে। অধ্যাপক আকিতাইনু প্রজাতির এই পশমী কুকুরটির নাম রাখেন ‘হাচিকো’। জাপানিজ ভাষায় ‘হাচি’ অর্থ আট এবং ‘কো’ অর্থ রাজপুত্র। আদর করে কুকুরটিকে হাচি বলেও ডাকতেন তিনি।
অধ্যাপকের প্রতিদিনের রুটিন ছিল প্রায় একই রকম। বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ায় অধ্যাপক সকালবেলা হাচিকোকে সঙ্গে নিয়ে শিবুয়া স্টেশনে আসতেন। হাচিকে বিদায় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য ট্রেনে চেপে যেতেন বাকিটা পথ। লেকচার শেষ করে বিকেল ৩টার সময় তিনি আবার ফিরে আসতেন শিবুয়া স্টেশনে, যেখানে হাচি তার জন্য অপেক্ষা করত। এরপর দুজনে মিলে হেঁটে সেখান থেকে বাড়ি ফিরতেন। এভাবেই পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছিল হাচিকো। স্টেশনের সবাই অল্প কিছুদিনেই চিনে ফেলেছিল অধ্যাপকের এই ছোট্ট বন্ধুটিকে। হাচির ছোট্ট পৃথিবীতে এই সময়গুলোই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। হাচিকো বাকি জীবনটা এভাবেই হয়তো কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না।
১৯২৫ সালের মে মাসের ৩১ তারিখ সকাল। বরাবরের মতোই অধ্যাপক বেরুচ্ছিলেন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করাবেন বলে। কিন্তু সেদিন কেন যেন হাচিকো সকাল থেকেই খুব চিৎকার করছিল। বারবার অধ্যাপকের পোশাক দাঁত দিয়ে কামড়ে টেনে ধরছিল, যেন আজ কিছুতেই যেতে দেবে না তাকে। স্টেশনে গিয়েও খুব চিৎকার শুরু করে কুকুরটি। অধ্যাপক ট্রেনে উঠে যান। আর ফেরা হয়নি তার। হিদেসাবুরো যখন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিলেন, সেই অবস্থায়ই তার হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান তিনি।
এদিকে অন্যান্য দিনের মতোই বিকেল ৩টায় হাচিকো উৎসাহ নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কেউ এলো না। অন্যপথে অধ্যাপকের কফিন মোড়ানো মরদেহ এসে পৌঁছায় তার বাসায়। কিন্তু হাচিকো অপেক্ষা করতেই থাকে। বিশ্বস্ত হাচিকো পরের দিন ঠিক ৩টায় শিবুয়া স্টেশনে গিয়ে একই জায়গায় বসে রইল। ভাবখানা এমন, হিদেসাবুরো এখনই ট্রেন থেকে নেমে তাকে কোলে তুলে নেবে আর সে লেজ নেড়ে তাকে সম্ভাষণ জানাবে। কিন্তু প্রিয় মনিব আজও এলো না। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নয় হাচি।
পরের দিন হাচিকোকে আবারও একই জায়গায় একই সময়ে বহাল তবিয়তে দেখা গেল। এভাবে দিনের পর দিন ধরে সে স্টেশনে এসে বসে থাকতে লাগল। এর কয়েক দিন পর কুকুরটিকে অধ্যাপকের পরিবার বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু হাচিকো কিছুতেই থাকতে চাইত না। সে ছুটে আসত স্টেশনে, তার বিশ্বাস অধ্যাপক ফিরবেনই! একটু দেরি হচ্ছে হয়তো!
অধ্যাপকের মৃত্যুর সাত বছর পর তার এক ছাত্র জানতে পারে অধ্যাপকের এই কুকুরটি এখনো অপেক্ষা করে থাকার কথা। সে শিবুয়া স্টেশনে কুকুরটিকে দেখতে আসে এবং আশপাশের লোকজন ও অধ্যাপকের বাগানের পুরোনো মালীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ‘Tokyo Asahi shambun’ নামক পত্রিকায় প্রকাশ করে। এর পরপরই হাচিকোর কাহিনি জাতীয়ভাবে সবার নজরে আসে এবং সে হয়ে ওঠে বিশ্বস্ততার এক জাতীয় প্রতীকে।
এভাবেই কেটে যায় ৯টি বছর! নিঃসঙ্গ কুকুরটি একা একাই স্টেশনে বসে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়ে দেয় তার জীবনের শেষ দিনগুলো, তার প্রভুর প্রতীক্ষায়। বিশ্বস্ততা আর বন্ধুবাৎসল্যের প্রতীক হিসেবে সবাই হাচির উদাহরণ দিতে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন হাচিকোকে একনজর দেখার জন্য জাপানে আসতে লাগল। টানা ১০ বছর ধরে ঝড়-বৃষ্টি, ঠান্ডা কোনো কিছুই হাচিকোকে রুখতে পারেনি, প্রতিদিনই সে স্টেশনে হাজির হতে লাগল। এমনকি বার্ধক্য আর আর্থ্রাইটিসকেও সে পাত্তা দেয়নি। তার মনে শুধু একটাই আশা, কোনো একদিন নিশ্চয়ই সে মনিবকে দেখতে পাবে, অন্তত একবারের জন্য হলেও। মাঝে মাঝে দলবেঁধে এলাকার লোকজন তার সঙ্গে আসত, কখনো সে একাই আসত।
এপ্রিল ১৯৩৪, শিবুয়া স্টেশনে হাচিকোর আদলে একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হয় হাচিকোর সম্মানে। এ মূর্তির উদ্বোধনে হাচিকো নিজেও উপস্থিত ছিল। প্রতি বছর ৮ এপ্রিল সেখানে পালন করা হয় শোক দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরপ্রেমীরা জড়ো হন সেখানে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মূর্তিটি রিসাইকল্ড হয়। ১৯৪৮ সালে মূল শিল্পীর ছেলের ওপর আবার দায়িত্ব দেওয়া হয় হাচিকোর মূর্তি নির্মাণের। একই বছরের আগস্ট মাসে মূর্তিটির উদ্বোধন করা হয়, যা আজও বর্তমান। জাপানের ব্যস্ততম এই স্টেশনে হাচিকোর মূর্তির কাছাকাছি অংশের নাম ‘Hachiko-guchi’ বা ‘The Hachiko Entrance/exit’। এই অংশটি সবার কাছে বিখ্যাত এক মিলন স্থান।
অবশেষে ১৯৩৫ সালের এক শীতল সন্ধ্যায় হাচিকো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, প্রাকৃতিকভাবেই। তার মৃতদেহ শহরের লোকজন রাস্তায় আবিষ্কার করল। সবাই গভীর আলিঙ্গনে তাকে বুকে তুলে নিল, তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করল হিদেসাবুরোর কবরের পাশেই। ১০ বছর পর প্রিয় মনিবের সঙ্গ পেয়ে হাচিকোর কেমন লাগছিল, তা জানার উপায় আর কারোই রইল না।
হাচিকো বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল, তার মৃত্যুতে কেঁদেছিল হাজারো মানুষ। তার স্মরণে শহরবাসী একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি তৈরি করে ঠিক সেই জায়গাটায়, যেখানে সে মনিবের জন্যে প্রতিদিন অপেক্ষা করত। এ ছাড়া এই সত্যি কাহিনির অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমা, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রিচার্ড গিয়ার অভিনীত Hachi : A Gog's Tale (আগস্ট ২০০৯), যা অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। seijiro koyama পরিচালিত Hachi-ko (Hachili Monogatari, ১৯৮৭)। এ ছাড়া Natural History Museum-এ গেলেও দেখা যাবে হাচিকোর সংরক্ষিত মমি।