Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

জিম করবেট: শিকারি হলেও ভালোবাসতেন বন্যপ্রাণী

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৩

জিম করবেট: শিকারি হলেও ভালোবাসতেন বন্যপ্রাণী

জিম করবেটের বহু দিনের সঙ্গী রাম সিংহ এসে দেখলেন সাহেব বারান্দায় পায়চারি করছেন।

নভেম্বর শেষের এক রাত, সালটা ১৯৪৭। ভারতের নৈনিতাল। প্রবল ঠান্ডা হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। জিম করবেটের বহু দিনের সঙ্গী রাম সিংহ এসে দেখলেন সাহেব বারান্দায় পায়চারি করছেন। একটা বস্তার ওপর টর্চের আলো ফেলে ইঙ্গিত করলেন করবেট। রাম সিংহ কাঁধে তুলে নেওয়ার সময় দেখল বেশ ভারী ওটা। ভেতরে কী আছে জানতে চাইলেন না একবারও। সঙ্গে নিয়ে আসা একজন লোকসহ অপেক্ষা করতে লাগলেন। জঙ্গলের দিকে ইশারা করলেন সাহেব। তারপর তিনজন দ্রুত পায়ে চললেন জঙ্গলের গভীরের দিকে। অন্ধকার হটিয়ে সূর্যের আলো হেসে উঠতে তখনো ঢের বাকি। 

প্রায় মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর গহিন বনের ভেতরে দাঁড়ানোর নির্দেশ এলো। তারপর একটি ঝোপের মধ্যে আলো ফেলে বস্তা খুললেন করবেট। শাবল, কোদাল, তিনটি রাইফেল আর দুটি শটগান বেরোল ভেতর থেকে। এরই একটি ১৯২৬ সালে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল রুদ্রপ্রয়াগের সেই দুর্ধর্ষ চিতা বাঘটার। ম্যান ইটিং ল্যাপার্ড অব রুদ্রপ্রয়াগ নামের এই কাহিনি পাঠকদের সামনে তুলেও ধরেছিলেন জিম করবেট। 

করবেটের নির্দেশে রাম সিংহরা গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। বেশ গভীর হলে একটা একটা করে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে লাগলেন সেখানে। তবে নামানোর আগে পরম ভালোবাসায় চুমু খেলেন প্রতিটি অস্ত্র। এদিকে হাউ মাউ করে কাঁদছে রাম সিংহ। প্রিয় শিষ্যের মাথায় গভীর মমতায় হাত রাখলেন সাহেব। 

আর নিজের সব অস্ত্র মাটি চাপা দেওয়ার কয়েক দিন পরই প্রিয় ভারত ছাড়েন করবেট। চলে যান কেনিয়ায় নিয়েরিতে। সেখানেই মারা যান, ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল। করবেটের মৃত্যুর ৭০ বছর পর প্রিয় এই শিকারি এবং বন্যপ্রাণী শিকারি ও সংরক্ষককে নিয়ে লিখতে বসে আজ আমার মনটাও ভার। 

ভারতের হিমালয় কোলের এক শহর নৈনিতাল। পাশের জঙ্গলে হরেক বন্যপ্রাণীর বিচরণ, পাখির কিচিরমিচির। উত্তরে তাকালে দেখা যায় হিমালয়ের বরফাবৃত চূড়া। এখানেই জন্ম জিম করবেটের, ১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই। আর এমন জঙ্গল এলাকায় যার জন্ম ছোটবেলা থেকেই তিনি অরণ্য ভালোবাসবেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কী?

বাবা ক্রিস্টোফার গার্নি জাতিতে ছিলেন আইরিশ। সাধারণ সরকারি চাকরি করতেন নৈনিতালে। যেখানে গার্নি হাউস নামে যে বাড়ি বানান সেখানেই জন্মান করবেট।

নৈনিতালের কথা বললেই চলে আসে বিখ্যাত তাল হ্রদের কথা। পাশেই নৈনি দেবীর মন্দির। করবেট লিখে গেছেন মন্দিরের চার মাইলের মধ্যে বাঘ, চিতা বাঘ, সম্বার ও ভাল্লুক দেখেছেন। এতটুকুন জায়গার মধ্যে চিনেছেন ১২৮ জাতের পাখি।

ভারতের উত্তরাখণ্ডের কুয়ায়ুনের কালাধুঙ্গির বোর নদীর তীরে বহু পুরোনো, জীর্ণ এক কাঠের সেতু। এর এক কিনারায় দেওয়ালে হেলান দিয়ে গল্প শুনছে আট থেকে আঠারো বছরের চৌদ্দজন ছেলেমেয়ে। গল্প বক্তা ড্যানস নামের এক আইরিশ। সময়টা রাত। চৌহদ্দির জঙ্গল থেকে কাঠকুটো এনে আগুন জ্বেলেছিল খুদে শ্রোতারা। 

নিভু নিভু আগুনের সামান্য আঁচ ঘন অন্ধকারকে কেবল কিছুটা ফিকে করছে। এই পরিবেশে একটি গল্পই জমে, ভূতের। তাই বলছে ড্যানশি। কিছুক্ষণের মধ্যে ভূত থেকে বানশিতে চলে যায় ড্যানশি। তবে ড্যানশির মতে আয়ারল্যান্ডের বানশি ভূত থেকেও ভয়ংকর। যে ছেলেমেয়েগুলো গল্প শুনছিল তাদের একজন ছোট্ট করবেট।

কালাধুঙ্গি ছিল জিম করবেটদের শীতকালীন নিবাস। করবেটের পরিবারের গ্রীষ্মকালীন নিবাস নৈনিতাল থেকে কালাধুঙ্গির দূরত্ব মেরেকেটে ১৫ মাইল। আর ওখানে রাতে বানশি, ভারতীয় গ্রামের ডাইনি চুরাইলের গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হতো বালক করবেট। 

জিম করবেটের শিকারে আগ্রহ বড় ভাই টমের উৎসাহে। দুই ভাই একসঙ্গে বের হতেন শিকারে, কালাধুঙ্গির জঙ্গলে। একটু বড় হলে, মানে কিশোর বয়সে একাই ফাটা নলের এক বন্দুক নিয়ে বনে ঘুরে বেড়াতেন জিম। নকল করতেন পশু-পাখির ডাক। আয়া খানসামাদের থেকে শেখেন হিন্দুস্তানি আর স্থানীয় পাহাড়ি ভাষা। এসব করতে করতে একসময় জাত শিকারি হয়ে উঠলেন জিম করবেট।

তবে শিকারি হলেও ছোটবেলা থেকেই বন্যপ্রাণীর প্রতি জিম করবেটের ছিল গভীর মমতা। একপর্যায়ে তো শিকার ছেড়ে মনোযোগ দেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে। ভারতের প্রথম ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান তার নামেই। বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অনেকেরই দাবি, ভারতে সংরক্ষণের বিষয়ে পথ দেখিয়েছিলেন জিম করবেটই। 

জিম করবেট, যাকে কুয়ায়ুনের বিভিন্ন গ্রামের মানুষগুলো কার্পেট সাহেব বলতেন, তিনি শিকারের পাশাপাশি বন ও বন্যপ্রাণ দুটি সংরক্ষণের মহিমাও বুঝিয়েছিলেন মানুষকে।

ভারতের গাড়োয়াল এবং কুমায়ুন এলাকায় মানুষখেকোর উপদ্রব ছিল একটা সময় খুব সাধারণ ঘটনা। কখনো চিতা বাঘ মানুষখেকো হতো। কখনো হতো বাঘ। কোনো কোনোটির পেটে যেত এমনকি শত শত মানুষ। এই যখন পরিস্থিতি তখন এ অঞ্চলের অসহায় মানুষের ভরসা ছিলেন করবেট। এই অঞ্চলের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করতেন করবেট। ভারতীয় রেলে নানা ধরনের চাকরি করেন দীর্ঘদিন। এর মধ্যে মোকামঘাটে রেলওয়ের ঠিকাদারি করেন ২০-২১ বছর। সেখান থেকেই অবসরে যান। 

তরুণ বয়সে বেতন যে খুব একটা বেশি পেতেন তা নয়। তবে মেহনতি-শ্রমজীবী মানুষের যেকোনো কষ্ট দেখলে নিজের সঞ্চয় ভেঙে তাদের সাহায্য করতেন বিনা দ্বিধায়। করবেটের ওই অঞ্চলের মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং তার রেলের কর্মজীবনের বর্ণনা মেলে মাই ইন্ডিয়া বইটিতে।  

দিনের পর দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে মানুষখেকোর পিছু নিতেন করবেট। তাই কোনো এলাকায় মানুষখেকোর উৎপাত হলে গ্রামের লোকেরা ছুটে আসত করবেটের কাছে।

 ১৯০৭ সালে প্রথম মানুষখেকো বাঘ শিকার করেন করবেট। ওটা চম্পাবতের মানুষখেকো। নেপাল ও ভারতের সীমানায় রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এটা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর ছিল যে ওটাকে মারতে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছিল। তার পরও ওটাকে বাগে আনা যাচ্ছিল না। তারপর করবেট মারেন রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটাকে। রুদ্রপ্রয়াগ এলাকা হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসেবে বিখ্যাত। পানারের মানুষখেকো, মোহন ও থকের মানুষখেকো বাঘসহ অনেক বাঘ আর চিতা বাঘ মারেন একে একে। 

তবে করবেটের কথা বিশ্বের মানুষ জানতে পারে যখন বই লেখা শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন লেখেন, তাও পরিচিত ও ভক্তদের পীড়াপীড়িতে। বলা চলে এটা অনেকটা রাতারাতি তাকে গোটা বিশ্বে পরিচিতি এনে দেয়। তারপর প্রকাশকদের চাপাচাপিতে একে একে লিখতে থাকেন অন্য বইগুলো। আর এভাবেই অসাধারণ সব ঘটনা এবং এর নায়ক জিম করবেট পাঠকের কাছে অমর হয়ে যান। 

তবে অনেক বাঘ মারলেও নিজে বাঘ ভালোবাসতেন করবেট। বাঘকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, ‘বিশিষ্ট ভদ্রলোক’ হিসেবে।

জিম করবেট শেষ মানুষখেকো শিকার করেন ১৯৩৯ সালে। এরপর আর কোনো বাঘ বা চিতা মেরেছেন তেমন খবর নেই। জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন বন্যপ্রাণী রক্ষায়। নিজের প্রভাব ও জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে করবেট প্রাদেশিক সরকারকে উৎসাহিত করেন হেইলি ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠা করতে। করবেটের মৃত্যুর দুই বছর পর জাতীয় উদ্যানটির নাম বদলে রাখা হয় জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। 

১৯৬৮ সালে বাঘের টিকে থাকা পাঁচটি উপপ্রজাতির একটির নাম রাখা হয়েছে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্যানথেরা ট্রাইগ্রেস করবেটি।

অপর শিকারি ও সংরক্ষক কেনেথ এন্ডারসনের প্রিয় এলাকা নীলগিরিতে যেমন যাওয়ার সুযোগ হয়নি, তেমনি আমার এখনো যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি করবেটের শিকার করা এলাকা হিমালয় অঞ্চল, করবেট ন্যাশনাল পার্ক, কালাধুঙ্গি ও নৈনিতালে। বছর কয়েক আগে হিমালয়ের ওই দিকটার প্রবেশদ্বার দেরাদুন পর্যন্ত গিয়েছিলাম। হয়তো কখনো একদিন হাজির হব প্রিয় কুমায়ুনে। করবেটের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুরে বেড়াব হিমালয় অঞ্চলের জঙ্গল-পাহাড়ে। 

করবেট ও তার বড় বোন ম্যাগি দুজনেই বিয়ে করেননি। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ম্যাগিসহ ভারত ছেড়ে কেনিয়ায় পাড়ি জমান করবেট। লেখা শেষ করতে গিয়ে পুরোনো প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসছে মনে, যে ভারতবর্ষকে এত ভালোবাসতেন করবেট, সেখান থেকে কেন চলে গেলেন বহু দূরদেশ কেনিয়ায়? 

ও একটা কথা, কেনিয়ায় রানি এলিজাবেথকে নিয়ে জিম করবেটের চমৎকার একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আছে। ‘ট্রি টপস’ নামে প্রকাশিত হয় সেটি। পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার অল্প ক’দিন আগেই মাত্র এটি লেখা শেষ করেছিলেন। 

সূত্র : আশাপূর্ণা দেবীর জিম করবেট সমগ্র, আনন্দবাজার পত্রিকা ও করবেটের বিভিন্ন বই


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫