
ইলেকট্রনিক পণ্যের বর্জ্য। ছবি: সংগৃহীত
নষ্ট মোবাইল, নষ্ট ল্যাপটপ, নষ্ট আইপিএস, নষ্ট টিভি বেচতে পারেন...বর্তমানে পাড়া-মহল্লার ফেরিওয়ালাদের মুখে নতুন এই হাঁক হরহামেশা শোনা যায়। অনেকেই ঘরে ফেলে রাখা নষ্ট ইলেকট্রনিক পণ্যটি সের হিসেবে কম দামে বিক্রি করে দেন হকারের কাছে। বিষয়টি সাধারণ হলেও কয়েক হাত ঘুরে এই পণ্যটিই হয়ে উঠছে পরিবেশের জন্য ভয়ের কারণ।
প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে এসব পণ্যের পরিত্যক্ত অংশ বা ই-বর্জ্য। এসব একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করছে, তেমনি বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ বর্জ্য যদি যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা না হয়, তবে তা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
ই-বর্জ্য কী ও কেন বিপজ্জনক
ব্যবহার অনুপযোগী বা বাতিল বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম যেমন- টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, মোবাইল, ওয়াশিং মেশিন, চার্জার, ব্যাটারি, সিআরটি মনিটর ইত্যাদি ই-বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্পত্তি না হলে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ মাটি, পানি ও বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষিত করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ই-বর্জ্যরে কারণে ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এখন সিআরটি মনিটরের পরিবর্তে এলইডি মনিটর প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এসবে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিয়াম, ফ্লুরোসেন্ট পাউডার থাকে; যা মাটি-জল-বাতাসকে দূষিত করে। যেমন- এক চা-চামচ পারদ ২০ একরের একটি জলাশয়ের পানি আজীবনের জন্য ব্যবহার অনুপযোগী করে তুলতে পারে।
বিশ্ব ও বাংলাদেশে ই-বর্জ্যরে চিত্র
জাতিসংঘের গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট মনিটর ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে প্রায় ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে, যা পরিবহন করতে প্রয়োজন হতো এক কোটি ১৫ লাখ ট্রাক। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের অর্থায়নে পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র এবং বুয়েট কর্তৃক পরিচালিত ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ই-বর্জ্যরে আনুমানিক পরিমাণ ছিল তিন লাখ ১০ হাজার মিলিয়ন টন ও চার লাখ টন। প্রতি বছর ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে ৩০ শতাংশ করে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। যেসব পুরোনো জাহাজ ভাঙার জন্য আনা হয়, সেখানে মূলত সেসব দেশের ই-পণ্য বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য বিদ্যমান থাকে। জাহাজ ভাঙার সময় এবং তৎপরবর্তী এসব বিষাক্ত ই-বর্জ্য মাটিতে ও পানিতে মিশে চক্রাকারে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে বছরে মোট ই-বর্জ্যরে মোট ৮০ শতাংশ আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে, আর বাকি ২০ শতাংশ মোবাইল, ল্যাপটপ, ফ্রিজ, এসি প্রভৃতি পণ্য থেকে।
যদিও দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, কিন্তু রিসাইক্লিং হয় মাত্র ১৩ হাজার ৩০০ টন। ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য অব্যবস্থাপিত থেকে যাচ্ছে। প্রতি বছর উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় ৩০ শতাংশ, যা ২০৩৫ সালে গিয়ে পৌঁছাবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টনে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা জানান, পুরোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী ভাঙারির দোকানে পৌঁছালে দোকানি সেগুলোকে রোদের তাপে শুকিয়ে নেন। অনেকে সেগুলোকে দোকানে না রেখে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। বিপদটা ঘটে তখনই। রোদের তাপে ‘ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট’ থেকে মারাত্মক বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। শুধু রোদেই নয়, এটি মাটির নিচে চাপা দিলে কিংবা পানিতে ফেলে দিলেও ক্ষতিকর বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। আর যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে ই-বর্জ্যরে রেডিয়েশন রিসাইকেলের মাধ্যমে মানবদেহে দ্রুত প্রবেশ করে।
জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি
২০১০ সালের এক গবেষণা মতে, বাংলাদেশে ই-বর্জ্যরে কারণে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ১৫ শতাংশের বেশি। ই-বর্জ্যে থাকা বিষাক্ত উপাদান সিসা, ফ্লুরোসেন্ট পাউডার ও ক্যাডমিয়াম মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র ও প্রজনন স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। চীনের গুইউকে বলা হয় ই-বর্জ্যরে রাজধানী। কেননা এখানে বিশ্বের ৭০ শতাংশ ই-বর্জ্য এই শহরের ওপর দিয়ে যেত। এ শহরে দুটি ভয়াবহ ঘটনা দেখা গেছে। এক. এখানকার মহিলাদের ৬ গুণ বেশি গর্ভপাত হয়েছে। দুই. এখানকার ৭০ শতাংশ শিশুর দেহে অস্বাভাবিক মাত্রার সিসা পাওয়া গেছে।
কী আছে নীতিমালায়
বাংলাদেশে ২০২১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীর দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। মজুদকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে কোনো প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনর্ব্যবহার উপযোগীকরণকারী ই-বর্জ্য ১৮০ দিনের বেশি সময় মজুদ করতে পারবে না। তবে আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা ৯০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
সম্ভাবনার দিকও আছে
সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এক টন পরিমাণ মেমোরি কার্ড ও মাদারবোর্ড থেকে প্রায় ৬০০ গ্রাম স্বর্ণ, সাড়ে সাত কেজি রুপা, ১৩৬ কেজি তামা ও ২৪ কেজি টিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। আবাসিক ও বিভিন্ন অফিসে ব্যবহৃত কম্পিউটার হার্ডডিস্কের অন্যতম একটি উপাদান হলো অ্যালুমিনিয়াম ও স্টেইনলেস স্টিল, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক হতে পারে এ দুটি উপাদানের ভালো একটি উৎস। অন্যদিকে জিংকের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হতে পারে ড্রাইলেস পরিত্যক্ত ব্যাটারি। এ উৎস থেকে ১৬.৯৮ শতাংশ জিংক পাওয়া যায়। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও ল্যাপটপের লিথিয়াম আয়ন ব্যবহার হয় বলে এ উৎস থেকে লিথিয়াম সল্ট প্রস্তুত করা সম্ভব, যা থেকে ২০৩০ সালের মধ্যেই এ খাতে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।
ব্যবস্থাপনায় করণীয় কী?
আমাদের বিধিমালা থাকলেও সেটির শিথিল প্রয়োগের কারণে এই সম্ভাবনাময় খাত বিকশিত হচ্ছে না। অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব অনুমোদন দানকারী কর্তৃপক্ষের। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে মারাত্মক স্বাস্থ্যর্ঝুকির দিক রয়েছে, সেটি বিবেচনায় এনে অনুমোদিত ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানার সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এর পাশাপাশি সেগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সরকারের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করতে হবে। ই-বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সরকারি উদ্যোগে কালেকশন পয়েন্ট স্থাপন করতে হবে। স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং গণমাধ্যমে ক্যাম্পেইন করতে হবে। সম্ভব হলে পুরোনো যন্ত্রপাতি ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কর রেয়াত বা আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ ও বিনিয়োগকারীদের ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং খাতে উৎসাহিত করতে হবে। ধারণা করা কঠিন নয় যে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় না রাখলে ইলেকট্রনিক পণ্য ও সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতেই আমাদের বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
ই-বর্জ্য সমস্যা কেবল পরিবেশগত নয়, এটি একাধারে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও নিরাপত্তারও ইস্যু। বাংলাদেশ যদি এখনই সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ না নেয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। তবে একই সঙ্গে এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগালে ই-বর্জ্যই হয়ে উঠতে পারে টেকসই উন্নয়নের এক বড় হাতিয়ার।