Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ছোট্ট পাখিও কেন উড়োজাহাজের জন্য বিপজ্জনক

Icon

আলপনা আকতার শ্রাবণী

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১৬:২৬

ছোট্ট পাখিও কেন উড়োজাহাজের জন্য বিপজ্জনক

দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৭সি২২১৬ থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মুআনে যাচ্ছিল। মুআন বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণের ঠিক আগে পাখির একটি ঝাঁকের সঙ্গে বিমানটির সংঘর্ষ হয়। ঘটনাটি ঘটে ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এতে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রানওয়ে থেকে ছিটকে বিস্ফোরিত হয় উড়োজাহাজটি।

এ দুর্ঘটনায় ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়, যা দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত।

যারা বিমান ভ্রমণে ভয় পান, তাদের সাধারণত মাঝ আকাশে ঝাঁকুনি (টারবুলেন্স) বা বিমানের কোনো অংশ খুলে যাওয়ার চিন্তাই বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখে। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই, পাখির ঝাঁকের সঙ্গে সংঘর্ষও বিমানের জন্য একটি বড় ঝুঁকি।

বিশ্বের নানা প্রান্তে হরহামেশাই এমন বার্ড স্ট্রাইক বা উড়োজাহাজের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে শুধু মাত্র ২০২২ সালেই প্রায় ১৪ হাজার বার্ড স্ট্রাইক হয়। একইভাবে, যুক্তরাজ্যের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ২০২৩ সালে উড়োজাহাজের সঙ্গে পাখির ধাক্কার ১,৫০০টি ঘটনা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে।

২০২০ সালে, ডেলফ্ট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির জার্মান গবেষকরা এবং জার্মান এয়ারস্পেস সেন্টারের নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব ফ্লাইট গাইডেন্স মিলিতভাবে একটি গবেষণা চালায়। তারা বিভিন্ন দেশে বিমানের চলাচলের সঙ্গে পাখির ধাক্কার হার পর্যালোচনা করেন। তাতে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বেশি পাখির ধাক্কার ঘটনা ঘটে। যা কিনা প্রতি ১০ হাজারটি বিমান চলাচলে প্রায় ৮টি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে এ হার সবচেয়ে কম, প্রতি ১০ হাজার বিমানের জন্য মাত্র ২ দশমিক ৮৩টি।

এ ধরনের সংঘর্ষে কখনো অল্পতে রক্ষা পাওয়া যায়, কখনো আবার প্রাণঘাতি হয়ে ওঠে।

উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় পাখি ইঞ্জিনের ভেতরে ঢুকে গেলে এটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটায়।

কিছু দুর্ঘটনা

১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৩৭৫পাখির সঙ্গে ধাক্কা খায়। লকহিড ইলেক্ট্রা বিমানটি বোস্টনের লোগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়ার মাত্র ২০ সেকেন্ডের মাথায় ইউরোপীয় স্টারলিংস পাখির একটি বড় ঝাঁকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে বিমানটির ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শক্তি হ্রাস পায়। একপর্যায়ে এটি বোস্টন হারবারে বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা ৭২ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জন বেঁচে যান, বাকিরা সবাই মারা যান।

১৯৮৮ সালে, ইথিওপিয়ার বাহির দার বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের সময় ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭৩৭ বিমানের ইঞ্জিনে একাধিক পাখি ঢুকে পড়ে। এতে বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি এতে থাকা ১০৪ জনের মধ্যে ৩৫ জন মারা যান।

তবে কখনো কখনো ব্যতিক্রমও আছে।

২০০৯ সালে, ইউএস এয়ারওয়েজ ফ্লাইট ১৫৪৯ উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর কানাডিয়ান রাজহাসের একটি ঝাঁকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। বিমানের ইঞ্জিনে পাখিগুলো ঢুকে পড়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পাইলট বাধ্য হয়ে নিউ ইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরি অবতরণ করেন। বিমানে থাকা ১৫৫ জন যাত্রী ও ক্রুকে নৌকার মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়, তবে ১০০ জন আহত হন। এ ঘটনা পরবর্তীতে ‘মিরাকল অন দ্য হাডসন’ নামে হলিউডের একটি সিনেমায় তুলে ধরা হয়, যেখানে টম হ্যাঙ্কস প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।

এর এক দশক পর, ২০১৯ সালে, একটি রাশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান গাঙচিলের ঝাঁকের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়। বিমানটি মস্কোর কাছে একটি ভুট্টার খেতে নামিয়ে আনা হয়। এ ঘটনাটি পরে ‘মিরাকল ওভার রামেনস্ক’ নামে পরিচিতি পায়। বিমানে থাকা ২৩৩ জনের মধ্যে ৭৪ জন সামান্য আহত হন কেবল।

বাংলাদেশেও পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের পর বড় একটি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ঘটনা ঘটে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগেই পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে বিমানটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে বিমানটি আকাশে ওড়ার আগে এ দুর্ঘটনা ঘটায় শুধু ফ্লাইট বাতিল ছাড়া আর কোনো ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি।

কেন পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে?

এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে পাখির ধাক্কা বা বার্ড স্ট্রাইক ঘটার কারণ কী? অর্থাৎ এটি কেন ঘটে? সাধারণত এটি তখন হয়, যখন বিমান উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় পাখির চলাচলের পথের কাছে চলে আসে। পাখিরা অনেক বিমানবন্দরের আশেপাশে থাকা খোলা মাঠ, জলাশয় এবং শুকনো স্থানগুলোতে খাবার খেতে আসে। কিন্তু এই সাধারণ অভ্যাসই পাখিদের বিমান চলাচলের পথে এনে ফেলতে পারে।

বিশেষ করে, পাখিগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচলের সময় তাদের উড়ালপথ অনেক সময় বিমানের উড়ালপথের সঙ্গে মিলে যায়। যার ফলে এদের সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষ হয়।

ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের মতে, ৯০ শতাংশ বার্ড স্ট্রাইক বিমানবন্দরের কাছাকাছি ঘটে।

ছোট্ট পাখি এত বিপজ্জনক হয়ে ওঠার কারণ

ছোট্ট পাখির ধাক্কাও বিশাল উড়োজাহাজের জন্য বিপজ্জনক কারণ যখন একটি পাখি বা পাখির ঝাঁক বিমানের সঙ্গে ধাক্কা খায়, এটি ইঞ্জিন, উইন্ডশিল্ড বা ডানার মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। এতে বিমানের শক্তি কমে যেতে পারে, নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে বা বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বিশেষ করে যদি উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় একাধিক পাখি ইঞ্জিনের ভেতরে ঢুকে যায়, তখন বিমানটির গতি কম থাকায় এটি মারাত্মক দুর্ঘটনা বা এমনকি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণও হতে পারে।

আবার উড়োজাহাজের আকারও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট বিমানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এক ইঞ্জিনের বিমান হলে এর প্রভাব আরও মারাত্মক হয়।

বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো

বিমানবন্দরগুলি যেখানে বন ও জলাশয়ের কাছে অবস্থিত, সেসব জায়গায় পাখির উপস্থিতি বেশি থাকে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের উপকূলীয় বিমানবন্দরগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। যেখানে পাখিরে বিচরণ বেশি হওয়ায় তা বিমানের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

এমন পরিস্থিতি এড়ানো যাবে যেভাবে

পাখির ধাক্কা এড়ানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বার্ড ডিটেকশন ক্যামেরা এবং রাডার সিস্টেমের ব্যবহার পাখির উপস্থিতি শনাক্ত করতে সাহায্য করে।

এ ছাড়া, কোথাও কোথাও পাখিদের খাবার ও বাসস্থানের স্থান বিমানবন্দরের কাছাকাছি থেকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে পাখিদের বিমানের কাছে আসার সম্ভাবনা কমে যাবে। তেমনি নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের সময়ও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলে ঝুঁকি কমবে।

সূত্র: আল জাজিরা, সিএনএন

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫