
আমার লেখাটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পড়বেন কি না জানি না! তবুও তার উদ্দেশে লিখছি।
একটি দুর্ঘটনার কথা দিয়ে শুরুটি করি।
আমি রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ১০ নম্বর রোডের এক বাসায় ভাড়া থাকতাম। অফিসের কাজ শেষ করে গাড়ি নিয়ে নিয়ে ফিরছিলাম। হঠাৎ নির্মাণাধীন এক ভবন থেকে দুটি ইট পড়ে আমার গাড়ির গ্লাসে, গাড়ির ছাদে। বিধাতার অসীম কৃপা থাকায় আমি সেই যাত্রায় বেঁচে যাই।
মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ১০ নম্বর রোডে ৬/এ নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে আমি এই দুর্ঘটনায় পড়ি। গাড়ি মেরামতের পেছনে আমার ক্ষতি হয়েছে অন্তত দুই লাখ টাকা। বাড়ির মালিক শেখ ইব্রাহীম সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী, দায়িত্বরত কেয়ারটেকার বিষয়টির সমাধান করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি ক্ষতিপূরণ পাইনি, উল্টো হুমকি-ধমকি পেয়েছিলাম। গাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছি, এরইমধ্যে আমার বাসাও বদল করেছি।
যা জেনেছি
আমি একজন মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক। নির্মাণাধীন ওই বাড়ির বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, বাড়িটির অনুমোদন আটতলা। কিন্তু বাড়ির মালিক ‘টাকার গরমে’ ১০ তলা ভবন করছেন। তিনি ইমারত বিধিমালা ভেঙেছেন। টাকার কাছে আইন-কানুন সব তুচ্ছ।
নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমি। বর্তমানে বাড়ির মালিক দেশে এসে নির্মাণকাজ তদারকি করছেন। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই রাজউকের বিসি কমিটির ১৭তম সভায় বাড়িটির নির্মাণ অনুমোদনপত্র পাস হয়। যার স্মারক নং- ২৫.৩৯.০০০০.০৯৮.৩৩.৪২৪.১৭-৭৯৮।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, তিনি প্রতি ফ্লোরে দুইটি করে ইউনিট নির্মাণের অনুমোদন নেন। কিন্তু সেখানে বিধিমালা তোয়াক্কা না করে নকশার ব্যতয় ঘটিয়ে করেছেন তিন ইউনিট। ৮ তলা ভবনে ১৪টি ইউনিট নির্মাণের কথা থাকলেও তিনি করেছেন ২১টি ইউনিট। এ ছাড়া ৮ তলার ওপরে অবৈধ দুই তলায় করা হয়েছে আরও ৬টি ইউনিট। নকশা অনুযায়ী ওই ভবনে ১৪ ইউনিটের অনুমোদন থাকলেও তিনি করেছেন মোট ২৭টি ইউনিট যা অনুমোদনের প্রায় দ্বিগুণ।
ভবন নির্মাণের বেলায় পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়ার নিয়ম থাকলেও বাড়িওয়ালা তা তোয়াক্কা করেননি। ইচ্ছামতো ডেভিয়েশন করেছেন। আবাসিক ভবনে গ্যারেজের জায়গা সংকুচিত করে সেখানে ইউনিট করেছেন, করেছেন দোকানও। এক্ষেত্রে আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক স্থাপনাও নির্মাণ করেছেন আইন না মেনে। এভাবে দ্বিগুণ বোঝা বহন করে গড়ে উঠছে ১০ তলা একটি ভবন। মনে হয় এটি ভবন নয়, একটি দানব। এভাবে আটতলার জায়গায় ১০ তলা ভবন নির্মাণ করায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদি ভূমিকম্প হয়, যদি আগুন লাগে তাহলে ওই ভবনের বাসিন্দাদের কী হবে?
রাজউক কি আমার অভিযোগ আমলে নিয়েছে?
আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গত বছরের ২৭ নভেম্বর রাজউকের জোন ৫ এর পরিচালক ও জোন ৫/১ এর অথরাইজড অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিই। পরিচালকের কাছে দেওয়া অভিযোগের এন্ট্রি নম্বর (৫১২, তারিখ: ২৭.১১.২০২৪) আর অথরাইজড অফিসারের কাছে এন্ট্রি নম্বর (৪৯৭, তারিখ: ২৭.১১.২০২৪)। জোনাল অফিস থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আদৌও নেওয়া হবে কি না জানি না। আমার লেখাটি পড়ার পর আশা করি জোনাল অফিসের কর্মকর্তারাও সজাগ হবেন, তারা উদ্যোগী হবেন। আশা করি, রাজউক চেয়ারম্যানও ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির খোঁজ-খবর নেবেন, সর্ষের ভেতর কোনো ভূত লুকিয়ে আছে কি না তিনি দেখবেন।
যখন অভিযোগ দিয়েছিলাম তখন অবৈধ অংশের গাঁথনি চলছিল। কেটে গিয়েছে ৭ মাস। এখন ভেতরে-বাইরে প্লাস্টার হয়েছে, টাইলস লাগানো হয়েছে। অবৈধ দুই তলায় স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিস থেকে বিদ্যুৎ সংযোগও নিয়েছেন। এখন উপায় কী?
৭ মাস আগে রাজউকে অভিযোগ দিলেও রাজউক থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না ভেবে খুব অসহায় বোধ করি, নিজেকে বিপন্ন লাগে। রাজউকের পরিচালক হামিদুল ইসলাম ও অথরাইজড অফিসার হাসানুজ্জামান কী ভুলে গেছেন আমার অভিযোগের কথা?
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী বাড়ির মালিক দেশে এসেছে। শুনেছি, বাড়ির মালিক রাজউকে ধরনা দিচ্ছেন। টাকা-পয়সা নিয়ে দেনদরবার করছেন। একবার অথরাইজড অফিসারের সঙ্গে আলাপ করছেন, একবার ইমারত পরিদর্শকের সঙ্গে আলাপ করছেন। বাড়িওয়ালা বুদ্ধি খুঁজছেন কীভাবে অনুমোদন ছাড়া গড়ে তোলা ৯ ও ১০ তলার ফ্লোর রক্ষা করা যায়! শুনেছি, রাজউকের কোনো কোনো কর্মকর্তা ওই অবৈধ অংশ টিকিয়ে রাখার বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছে। রাজউকে টাকা দিলে নাকি সব হয়? টাকার খেলায় ভেসে যায় ইমারত বিধিমালা, ভেসে যায় আইন-কানুন।
একজন ভুক্তভোগী নাগরিক হিসেবে আমার জানার খুব ইচ্ছা রাজউক কি ছলেবলে কৌশলে কিংবা কোনো উপায় বের করে ওই বাড়িওয়ালার অনুমোদনহীন দুই তলা টিকিয়ে রাখবে? ভয় হয় একটি অনিরাপদ ১০ তলা ভবন মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সেই ভবনে থাকবে কতশত মানুষ, বসবাস করবে বৃদ্ধ, শিশুরাও। একদিন যদি খবর আসে, ৮ তলার অনুমোদন নিয়ে করা ১০ তলা ভবন ধসে যাচ্ছে, মাটির নিচে বসে যাচ্ছে- তখন কী হবে? যদি ভবনের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় কোনো প্রাণ। আমার প্রশ্ন, রাজউক কী কিছুই করবে না?
রাজউক চেয়ারম্যানের ‘মন খারাপ’
সংবিধান অনুযায়ী আমি প্রজাতন্ত্রের মালিক, রাজউক চেয়ারম্যান আমার সেবাদাতা। আমি একজন সচেতন নাগরিক ও ভুক্তভোগী হিসেবে গতকাল (২১ মে) রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। রাজউক চেয়ারম্যানের সামনের ওয়েটিং রুমে সাদা কাগজে লেখা ‘অনুমতি ছাড়া এই কক্ষে বসা নিষেধ’। তবুও বসেছিলাম যদি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা যায়। দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের কাছে বললাম, চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেখান থেকে বলা হলো- ‘চেয়ারম্যান স্যারের মন খারাপ। আজকে কোনো সাংবাদিক কিংবা কোনো ভিজিটরদের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন না।’ চেয়ারম্যাসের পিএস এর সঙ্গে কথা বললাম, তিনিও বললেন, চেয়ারম্যান স্যার আজ কারও সঙ্গেই দেখা করবেন না।
কেন রাজউক চেয়ারম্যানের মন খারাপ? আনসার সদস্যরা জানালেন, ড্যাপ নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। গতকাল (২০ মে) রাজউকের সামনে লোকজন জড়ো হয়েছিল। তারা রাজউক চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়েছে। স্যার এখন বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় আছেন। আজ (বুধবার ২২ মে) তিনি কারও সঙ্গেই দেখা করবেন না। বাইরের কেউই রাজউক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না।
এরপর গেলাম রাজউকের জনসংযোগ ও প্রটোকল শাখার সহকারী পরিচালক মোঃ আব্দুল্লাহ আল মারুফের কাছে। তাকে জানালাম, কীভাবে ৮ তলার অনুমোদন নিয়ে গড়ে উঠেছে ১০ তলা ভবন। তিনি বললেন, চেয়ারম্যান স্যারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিতে। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন জনসংযোগ কর্মকর্তা। আমি আদৌও জানি না, কতটুকু সহযোগিতা পাব? নাকি রাজউক চেয়ারম্যান আমার দেওয়া অভিযোগের ব্যাপারটি ভুলেই যাবেন।
তবুও আমি আশা করি, রাজউক শক্ত ভূমিকা নেবে। এভাবে মাথাচাড়া দিয়ে নির্মাণ করা ঝুঁকিপূর্ণ দানব ভবন আমরা চাই না। আমাদের শহরটি সুন্দর হোক। আমরা শান্তিতে ঘুমুতে চাই, নিরাপদে ঘুমুতে চাই। ঘুমন্ত অবস্থায় কোনো ভবনের ভেতর চাপা পড়ে মারা যেতে চাই না।
রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ ওই ভবনটির বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। ভবনটির অবৈধ অংশ উচ্ছেদ করতে আপনি কঠোর হবেন। যেন কোনো ‘সাপলুডু’ খেলায় ভবন মালিক পার পেয়ে না যান। আগেই বলেছি, ওইদিন মাথায় ইট পড়ে আমিও মারা যেতে পারতাম।
বুঝলাম আপনার মন খারাপ। কিন্তু আমারও মন খারাপ। এভাবে একটি ভবন ঝুকিপূর্ণ হোক, নগর ঝুঁকিপূর্ণ চাই না।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক