Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

মব জাস্টিস ও প্রতিকার

Icon

লোকমান হাওলাদার

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১৭:৫৮

মব জাস্টিস ও প্রতিকার

প্রতীকী ছবি

দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি উত্তেজিত জনতার হাতে পিটুনিতে মানুষ নিহত হচ্ছে। এই ঘটনাগুলোকে আমরা ‘মব জাস্টিস’ নামে চিনি, যার প্রকৃতি ভয়াবহ এবং যার পরিণতি মারাত্মক। এই প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। প্রতিটি ঘটনার পর সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মব’ শব্দটি ঘুরে-ফিরে আসে। শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘mobile vulgus’ থেকে, যার অর্থ ‘চঞ্চল জনতা’। সহজভাবে বললে, মব হচ্ছে এক উত্তেজিত, নিয়ন্ত্রণহীন জনসমষ্টি, যারা মুহূর্তের মধ্যে সহিংস আচরণে জড়িয়ে পড়ে।
‘মব জাস্টিস’ বলতে বোঝায় উত্তেজিত জনতার হাতে কাউকে পিটিয়ে মারা, গণপিটুনি, ঘরবাড়ি বা দোকানে হামলা, এমনকি আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। এই ধরনের সহিংসতা সাধারণত জন্ম নেয় গুজব, ধর্মীয় উসকানি, সামাজিক ক্ষোভ কিংবা আইনের প্রতি অনাস্থা থেকে। অনেক সময় এসব ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা কোনো অপরাধ ঢাকার চেষ্টাও থাকে। কখনো কখনো একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সংঘাত সৃষ্টির জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে জনতাকে উত্তেজিত করে তোলে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, একটি ছোট গুজব যেমন- শিশু চুরি, গরু চুরি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করার জন্য যথেষ্ট। মুহূর্তেই কয়েকশ মানুষ একত্রিত হয় এবং সহিংস হয়ে ওঠে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন গুজব চোখের পলকে ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলো মানুষ যাচাই না করেই বিশ্বাস করে। এই প্রবণতার পেছনে একটি বড় কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যেখানে সাধারণ মানুষ মনে করে, আদালত বা পুলিশ সুবিচার দেবে না, তাই তারা নিজেরাই ‘বিচারক’ হয়ে উঠতে চায়।
কিন্তু মব জাস্টিস কোনোভাবেই বৈধ নয়। এটি আইন ও মানবাধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। বরং এটি একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ইচ্ছাকৃত হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি জনতা কোনো অপরাধ সংঘটিত করে, তবে সেই জনতার প্রত্যেক সদস্যই দায়ী হবে। আবার ১৪৭ ধারায় দাঙ্গা বা সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড হতে পারে। ৩৪ ধারায় বলা আছে, সম্মিলিতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীই সমানভাবে দায়ী থাকে।
এই আইনগুলো স্পষ্ট করে বলে দেয়, জনতা মিলে কাউকে মারধর বা হত্যা করলেই দায় এড়ানো যায় না। প্রত্যেক মব সদস্যকে আলাদাভাবে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা যায়। এ ক্ষেত্রে ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, মোবাইল কল রেকর্ড বা লোকেশন ডাটা- সবই প্রমাণ হিসেবে কাজে আসে। এমনকি এ ধরনের অপরাধকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ না জানালেও রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে মামলা করতে পারে।
মব জাস্টিস সমাজে ভয়, আতঙ্ক ও আইনহীনতার একটি সংস্কৃতি তৈরি করে। এতে আইনের শাসন ভঙ্গ হয় এবং বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। বিচার কখনোই উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেওয়া যায় না। যারা মব জাস্টিসকে সমর্থন করে, তারা আসলে ন্যায়বিচার নয়, প্রতিশোধের পথকেই উৎসাহিত করে।
আমরা যদি একটি সভ্য, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে চাই, তাহলে মব জাস্টিসের মতো অমানবিক ঘটনার বিরুদ্ধে সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য দরকার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার, গুজব রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা, সামাজিক মাধ্যমে তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ।
সবচেয়ে বড় কথা, অপরাধ হলেও বিচার করার একমাত্র বৈধ প্রতিষ্ঠান হলো আদালত, জনতা নয়। মব মানেই সহিংসতা, মব মানেই বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধ। তাই আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার হোক নিয়মতান্ত্রিক, মানবিক ও আইনসম্মত। এটাই একটি সত্যিকার অর্থে সভ্য সমাজের ভিত্তি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫