
প্রতীকী ছবি
২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার বিপর্যস্ত রাষ্ট্রের ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর ১০ মাস পার হয়ে গেছে। বাস্তব অবস্থা হলো, এই ১০ মাসের সরকার ক্ষমতায় বসেছে সাড়ে ১৫ বছর, এমনকি বলতে গেলে চুয়ান্ন বছরের জঞ্জাল মাথায় নিয়ে। তারপরও নানা কারণে প্রশ্ন উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার ১০ মাস পর আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? অভ্যুত্থান-পরবর্তী ১০ মাসে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থাটি কী রকম? জন-আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নের উত্তর খুব আশাব্যঞ্জক বলে মনে হয় না।
একদিকে দেশে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ‘মবতন্ত্র’, অন্যদিকে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তাদের মদদকারী পৃষ্ঠপোষকদের নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও নাশকতার কারণে দেশের স্থিতিশীলতা মারাত্মক হুমকির মুখে। এদিকে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, জবরদখল সমানতালেই চলছে। খুন-খারাবি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই আগের মতোই চলছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটময়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অবস্থা আগের মতোই দুর্বিষহ। কৃষি ও শিল্পাৎপাদনের সংকট উদ্বেগজনক। কঠোর শর্তে আইএমএফের ঋণের বোঝা আরো ভারী হয়ে উঠেছে। চলছে মানব করিডর এবং সামুদ্রিক বন্দর নিয়ে আত্মঘাতী তৎপরতা। এগুলো সবই হচ্ছে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ। উদ্বেগ উৎকণ্ঠার আরো বড় কারণ হচ্ছে, সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে ধর্মের নামে গোঁড়া ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থানের দৃশ্যমানতা।
দুই.
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাত্র-যুবারা, যে অঙ্গীকার তৈরি করেছেন সেটি হলো চুয়ান্ন বছরের ঔপনিবেশিক ধরনের স্বৈরাচারী লুটেরা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর আধাখ্যাচড়া সংস্কার নয়, আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের উত্থানের দৃশ্যমানতা। এ ছাড়া রাজনীতি ও মতাদর্শের দিক থেকে যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেই বৈষম্য এখনো প্রকটভাবে বিরাজমান, অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রায় সব সদস্যই ব্যক্তিগতভাবে সৎ, দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল। নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও অনেক ভালো কাজও তারা করেছেন এবং করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, এ সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে বিদ্যমান ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে। রাষ্ট্রের রূপান্তর বা সংস্কার যা-ই বলা হোক- এ যেন ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ রাষ্ট্রের মধ্য থেকে রাষ্ট্র পরিবর্তনের মহড়া। এদিকে রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য এখন বিভেদে রূপ নিয়েছে। একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িও চলছে। ‘নির্বাচন আগে, না সংস্কার আগে’- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বাগযুদ্ধ এখন রাজপথেও মহড়া দিচ্ছে। এভাবে দেশ আজ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়েছে। জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-যুবাদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি, হঠকারিতা, অনমনীয়তা, শিশুসুলভ গোঁয়ার্তুমি, নিজেদের মধ্যে দলাদলির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি এদের কারো কারো বিরুদ্ধে বিএনপি ও ছাত্রদলের কর্মীদের মতো চাঁদাবাজির অভিযোগও উঠেছে। এখন কথা হলো, বিপ্লবীমনা তরুণ ছাত্র-যুবাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি যা-ই থাকুক, দেশে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের প্রধান কৃতিত্ব তাদেরই। তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমরা যদি আস্থা হারিয়ে ফেলি, তাহলে ভরসা করার মতো সামনে আর কোনো শক্তিই থাকে না।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সার্বভৌম ও জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এই রূপান্তরটি দুইভাবে ঘটতে পারে, এক. বৈপ্লবিক উল্লম্ফনের মাধ্যমে এবং দুই. দীর্ঘকালীন গণশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি অনুশীলনের মাধ্যমে। বৈপ্লবিক উল্লম্ফনের মাধ্যমে রূপান্তর ঘটানোর জন্য জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণ ছাত্র-যুবাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব ছিল, সফল গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অভ্যুত্থানকে দেশব্যাপী গণবিপ্লবে পরিণত করা। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ছাত্র-যুবারা সেটি করতে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হয়ে তারা যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন, সেই সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় বিদ্যমান বিতর্কিত সংবিধান এবং ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে থেকে ফ্যাসিস্ট শাসনামলের রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে, যা হলো গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ফলে বৈপ্লবিক উল্লম্ফনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের রূপান্তরের পথ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ও অঙ্গীকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ে, যা এখন বাস্তবে দৃশ্যমান। এখন প্রশ্ন হলো, যে তরুণ ছাত্র-যুবারা আবিশ্বাস্যভাবে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এক পরাক্রমশালী ও ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটাতে পারলেন, তারা গণ-অভ্যুত্থানকে গণবিপ্লবে পরিণত করতে পারলেন না কেন? এর প্রথম কারণ হলো, ছাত্র-যুবারা অভ্যুত্থানকালে তাৎক্ষণিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেও তারা রাজনৈতিক ও মতাদর্শিকভাবে কোনো সাংগঠনিক শক্তি ছিল না। ‘অভ্যুত্থান আগে, না গঠন আগে’, এ দেশের সব রাজনৈতিক দল নয়, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবেই। আবারও আমরা বলতে চাই, শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে। মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়েও তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। দ্বিতীয়ত, তরুণ প্রজন্মকে রাজনৈতিক, দার্শনিক ও মতাদর্শগতভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো দলও ছিল না। প্রচলিত আমলা-বুর্জোয়া ধারায় সংগঠিত বড় দলগুলো অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল শুধু শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, বিদ্যমান আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটানোর জন্য নয়। কারণ ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই তাদের জন্য সুবিধাজনক।
এ জন্য বলা যায়, গণ-অভ্যুত্থানকে গণবিপ্লবে রূপান্তরিত করতে না পারার ব্যর্থতার দায় তরুণ ছাত্র-যুবাদের নয়। এর দায় চুয়ান্ন বছরের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের। অনেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে একটি স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান বলে আখ্যায়িত করেন। আমি এই কথার সঙ্গে একমত নই। কারণ রাজনীতি-সচেতন ছাত্র-যুবাদের নেতৃত্বে চালিত এই অভ্যুত্থানের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে একটি দৃপ্ত অঙ্গীকার ছিল, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল। তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় নানা বৈরী পরিস্থিতির কারণে গণ-অভ্যুত্থানকে গণবিপ্লবে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েও ছাত্র-যুবারা হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে যাননি।
এক দিনের জন্যেও তারা রাস্তা ছাড়েননি। বরং বিদ্যমান চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মধ্যেও সমাজপরিবর্তনের লক্ষ্যে তারা এরই মধ্যে একটি বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠন করে সাহস, দৃঢ় মনোবল ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তারুণ্যের অতি উচ্ছ্বাস, অস্থিরতা, তাড়াহুড়া, বুদ্ধিহীনতা ও পেটি বুর্জোয়াসুলভ মনমানসিকতা থেকে তারা যদি মুক্ত থাকতে পারেন, তাহলে আমি নিশ্চিত, আজকের এই নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠবে অর্ধমৃত জাতির মুক্তির অগ্রদূত। তরুণরা শুধু দেশের ভবিষ্যৎ নন, বর্তমানও। তরুণদের পরাজয় মানে বাংলাদেশের পরাজয়। তরুণদের পরাজয় হলে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুই অন্ধকার।