
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় সিলেবাস এর মাধ্যমে। কোন বিষয়ে কী পড়ানো হবে তা সিলেবাসে লেখা থাকে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ান এবং সিলেবাস শেষ করেন। পরীক্ষায় প্রশ্ন হবে সিলেবাস থেকে। এর অর্থ, আপনি কী পড়েছেন তার মূল্যায়ন হবে। এর ফলে মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো করা যেত। পরবর্তীতে তাচ্ছিল্য করে এই পড়া নিয়ে একটি পঙ্ক্তি প্রচলিত হয়। বলা হয়, ‘পুথি গত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন, হলে প্রয়োজন’ কারণ এই ‘পুথিগত বিদ্যা’ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায় না।
আমাদের দেশে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা নব্বই দশক পর্যন্ত সিলেবাস নির্ভর ছিল। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে নব্বই দশকের শেষের দিকে আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নামে কারিগরি এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরুর দিকে এই সব শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানে সিলেবাসভিত্তিক শিক্ষা দান চলমান থাকে। ২০০৬ পরবর্তী সময়ে ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার এর ব্যপক প্রসারে শিক্ষায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্যে অনেক বিভাগ তাদের প্রোগ্রাম বা সনদ অ্যাক্রিডিটেশন করার দিকে মনোযোগ দেয়। আন্তর্জাতিকমানের সনদ প্রদান করার উদ্দেশ্যে সিলেবাস পদ্ধতি পরিবর্তন করে কারিকুলাম পদ্ধতি যুক্ত হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, সিলেবাস এবং কারিকুলাম এর তফাৎ কী? সহজ উত্তর, সিলেবাস একটা নির্দিস্ট বিষয়ের ওপর তৈরি করা হয়। এতে কিছু তত্ত্বীয় বিষয় থাকে যা জানতে পারলেই হয়। অন্যদিকে, কারিকুলাম একজন শিক্ষার্থীর শিখন ফল নির্ধারণ করে দেয়। এখানে কী পড়লেন তা মুখ্য নয়, কী পারবেন তাই মুখ্য। এক্ষেত্রে কারিকুলাম একজন শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনের কর্মক্ষেত্র ঠিক করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন ১৯৯০ সালে প্রথম শিক্ষা ব্যবস্থা এবং কর্মক্ষেত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে স্টেম এর প্রস্তাবনা করে। এই ব্যবস্থার মূল উপাদানসমূহ হলো, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত সংক্ষেপে স্টেম নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে যে কোনো স্তরের শিক্ষা কারিকুলামে কিছু সুনির্দিস্ট দক্ষতা যুক্ত করা হয়। এই দক্ষতা গুলা হলো, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ, দলগত কাজ, স্বাধীন চিন্তা, উদ্যোগ, যোগাযোগ, এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা। আশা করা হয় যে সকল শিক্ষার্থি স্টেম শিক্ষার কারিকুলামে অংশ গ্রহণ করেছে তারা এই সকল দক্ষতা অর্জন করে।
এইক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তবতা কী? আমাদের দেশে শিক্ষার চারটি ধাপ আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, এবং উচ্চ শিক্ষা। প্রশ্ন হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটা ধাপে কীভাবে স্টেম শিক্ষার দক্ষতা সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা যায়? প্রথমত, প্রতিটা বিষয়ের কারিকুলাম এমনভাবে বিন্যাস করতে হবে যেন কোনো না কোনোভাবে স্টেম শিক্ষার আটটি (০৮) দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকে। শিক্ষার প্রতিটা বিষয়ে এই দক্ষতা অর্জনের জন্যে শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
বর্তমানে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার কর্মঘণ্টা কম করে রাখা হয়েছে। এর বড় কারণ আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা। একজন শিক্ষার্থী একদিনে একটি শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানে কতক্ষণ থাকতে পারবে? বর্তমান ব্যবস্থায় চার ঘণ্টা। এর সঙ্গে যোগ হবে বাসা থেকে যাওয়া এবং আসার জন্যে দুই ঘণ্টা সময়। সব মিলিয়ে এখনই একজন শিক্ষার্থী ন্যূনতম ছয় ঘণ্টা সময় দেয়। এই সময়ের চেয়ে বেশি রাখতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক অনেক সুযোগ, সুবিধা, জনবল এবং সম্পদ বাড়াতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষায় সাধারণভাবে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গনিত, পরিবেশ পরিচিতি, সমাজ, শারীরিক শিক্ষা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, চারু ও কারুকলা, ধর্ম শিক্ষা পড়ানো হয়। মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত এর সাথে নবম দশম শ্রেণীতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, ভূগোল ও পরিবেশ, অর্থনীতি, পৌরনীতি ও নাগরিকতা, হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং, ব্যবসায় উদ্যোগ, কৃষিশিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, এবং কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা যুক্ত আছে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থী সাধারণভাবে আগের স্তরের ছয় থেকে সাতটি বিষয় নিয়ে পড়ে। যদিও শিক্ষাক্রমে প্রায় ৩২টি বিষয় আছে। উচ্চ শিক্ষায় সাধারণভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রযুক্তি, মেডিক্যাল, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সামাজিক ও কলা বিষয়ক বিষয়াবলি নিয়ে পড়া যায়। স্টেম শিক্ষার আটটি লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রতিটি বিষয়ের শ্রেণি কার্যক্রমে তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কীভাবে তা করা যায় তার একটা রূপরেখা উদাহরণসহ দেওয়া হলো। সাধারণভাবে একজন শিক্ষক শিক্ষার স্তরের একটি শ্রেণিতে কোনো একটি বিষয় পড়াচ্ছেন। এক্ষেত্রে সৃজনশীলতা, দলীয় কাজ, যোগাযোগ, এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা এই চারটি দক্ষতা সকল বিষয়ে শিক্ষার সকল স্তরে সমানভাবে প্রয়োগ করা যায়।
পাঠ কার্যক্রমে ডিজিটাল সাক্ষরতা অন্তর্ভুক্ত করতে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয় এমন একটি কাজ দেন। ইন্টারনেট থেকে একটি ছবি ডাউনলোড করে তাতে রঙ করা, ছবিটি স্ক্যান করা, রঙ করা ছবিটা শিক্ষককে ইমেইল করে পাঠানো, এই ছবিটা প্রিন্ট করা, বই এর এক পৃষ্ঠা কম্পিউটারে টাইপ করা, প্রিন্ট করা ইত্যাদি। পাঠ কার্যক্রমে দলীয় কাজ অন্তর্ভুক্ত করতে তিন জনের একটা দল গঠন করে তাদের শ্রেনীর বা বাড়ির কাজ দেন। এই দলকে উপস্থাপনা করতে দেন। কোনো একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দেন।
অনলাইনে ব্যবহার করে একটা ইভেন্ট পরিচালনা করতে দেন। যেমন কোনো একটা দিবস উপলক্ষ্যে রচনা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপস্থাপনার আয়োজন করা যায়। এই সব কিছু অনলাইনেই করা। এভাবে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, এবং দলগত কাজ করার অভিজ্ঞতা তৈরি হবে। সৃজনশীলতা তৈরির সবচেয়ে ভাল উপায় হল স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের সীমা দেওয়া যাবে না। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে সব সময় অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বাড়াতে অ্যাসাইনমেন্ট এর ফলাফল হিসেবে শুধু কাগজে লেখা রিপোর্ট এর পাশাপাশি ভিডিও, অডিও, এনিমেশন, উপস্থাপনা, অনলাইন পেইজ, অথবা অন্য কোন মাধ্যমে উৎসাহিত করা যায় । যোগাযোগ, অনেক রকমের হতে পারে। এখানে মূলত ভাষাগত যোগাযোগ বোঝানো হয়েছে। ভাষাগত যোগাযোগ দক্ষতা অর্জনের জন্যে সবচেয়ে বড় বাধা হলো কথা বলার সহপাঠী নেই। এক্ষেত্রে ভাষা শিক্ষার চারটি উপাদান বলা, শোনা, পড়া এবং লেখা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাক্রমে ভাষা শিক্ষায় শুধু লিখাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অন্য তিনটি জরুরি দক্ষতা যেমন বলা, শোনা, এবং পড়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
এর বড় কারণ হিসেবে আনুষঙ্গিক যন্ত্রাদির যেমন মাইক, স্পিকার, অ্যামপ্লিফায়ার, শব্দ নিরোধক বিশেষ কক্ষ ইত্যাদির অপ্রতুলতাকে দায় দেওয়া হয়। তবে এখন এই কাজটি খুব সহজে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেই করা যায়। ভাষা শিক্ষার জন্যে শুধু শিক্ষকের ওপর নির্ভর না থেকে এই সংক্রান্ত বিশেষ সফটওয়্যার মোবাইল ফোন এর মাধ্যমে সবার ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে।
স্টেম শিক্ষার অন্য চারটি দক্ষতা সমূহ বিকাশের জন্যে উচ্চ শিক্ষা সবচেয়ে উপযোগী। এর বড় কারণ, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের অনুপাত তুলনামূলকভাবে ভালো। এক্ষত্রে পরিকল্পনা এবং স্বাধীন চিন্তা, এই দুটি দক্ষতা অর্জনের জন্যে শিক্ষার্থীদের কো-কারিক্যুলার কার্যক্রম এ অংশ নিতে হবে। এই কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয় বিভিন্ন ক্লাব এর মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সাধারণত ১০-২০ টি ক্লাব থাকে। এই ক্লাব গুলো মুলত শিক্ষার্থীরা কমিটির মাধ্যমে পরিচালনা করে। ক্লাবের মাধ্যমে বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা, আলোচনা, বক্তৃতা, কনফারেন্স, প্রশিক্ষণ, ভ্রমণ ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এই দুইটি দক্ষতা মুলত শিক্ষার্থীদের একাডিমিক এবং গবেষণামূলক কাজের গুণগত মান বৃদ্ধিতে কাজ করে। এই দুটি দক্ষতা অর্জনের সবচেয়ে ভাল উপায় হলো একজন শিক্ষকের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থেকে গবেষণা সহকারী, প্রোজেক্ট /থিসিস শিক্ষার্থি অথবা স্বাধীন গবেষক হিসেবে কাজ করা।
একটি গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষায় সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ১০% এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২% শিক্ষার্থি স্টেম শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর বিভিন্ন উপাদান যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, ড্রোন, থ্রিডি প্রিন্টিং, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন এর মত উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে স্টেম শিক্ষা মানিয়ে নিতে শেখায়। ফলে বাজারে নতুন-নতুন পণ্য ও সেবা আসে এবং এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। কর্মজীবনে স্টেম শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দক্ষ কর্মী হিসেবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে তাদের আয় তুলনামূলকভাবে বেশি। দেশের অর্থনীতিতে সেটি অবদান রাখে। স্টেম শিক্ষায় যারা শিক্ষিত তাদের জন্য প্রতিবছর ১৭ শতাংশ হারে কাজের সুযোগ বাড়ছে। আর অন্য ডিগ্রিধারীদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ছে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। এককথায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এ তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্টেম শিক্ষায় বিনিয়োগের এখনই সময়।