
ভারতীয় সরকার সমর্থিত প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে চার দিনের যুদ্ধের খবর প্রচার করতে গিয়ে যে নজিরবিহীন মিথ্যাচার চালিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট গত ৪ জুন তুলে ধরে। গত ৯ মে মধ্যরাতে একজন ভারতীয় সাংবাদিক হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রসার ভারতীর কাছ থেকে একটি মেসেজ পান যে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং একটি ক্যু প্রক্রিয়াধীন। প্রসার ভারতী একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রচারমাধ্যম। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই সাংবাদিক খবরটি এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেন এবং অনেকেই তাকে অনুসরণ করেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সামাজিকমাধ্যমে খবরটি ভাইরাল হয়ে যায়। কিন্তু খবরটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা।
ওয়াশিংটন পোস্ট ভারতীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী নিউজ চ্যানেলের দুই ডজনের বেশি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন। বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তারা কথা বলেন। মার্কিন পত্রিকাটি জানতে চায় কিভাবে ভারতের প্রায় পুরো সংবাদমাধ্যম এমন ব্যাপক মিথ্যাচার প্লাবনের স্বীকার হয়! উত্তরদাতারা সবাই পরিচয় গোপন রেখে কথা বলতে রাজি হন।
যুদ্ধের ব্যাপকতা যখন বেড়ে চলছিল; তখন চরম জাতীয়তাবাদ ও অস্বাভাবিক বিজয় কাহিনি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলতে গেলে তাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়।
টাইমস যেটি বর্তমানে নবভারত, তারা জানায়, ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে; টিভি৯ ভারতবর্ষ জানায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আত্মসমর্পণ করেছেন; ভারত সমাচার জানায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী একটি বাংকারে লুকিয়ে ছিলেন। সব চ্যানেল এমনকি জি নিউজ, এবিপি নিউজ ও এনডিটিভি দাবি করে, পাকিস্তানি নগরগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। এগুলোর সমর্থনে তারা বিভিন্ন পুরোনো ভিডিও ক্লিপ, গাজা ও সুদানের যুদ্ধ, ফিলাডেলফিয়ার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এমনকি কিছু ভিডিও গেমের অংশবিশেষ জুড়ে দেয়।
জি নিউজ, এনডিটিভি, এবিপি নিউজ, ভারত সমাচার, টিভি৯ ভারতবর্ষ, টাইমস নাউ ও প্রসার ভারতীকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। ‘টিভি নিউজ চ্যানেলগুলোর একটি অংশ গত এক দশক ধরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যা করছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক সংস্করণ’, কথাটি বলেন নিউজলন্ড্রি নামের একটি স্বাধীন গণমাধ্যমের সংবাদ সমালোচক মনিষা পান্ডে। তিনি বলেন, এই পর্যায়ে তারা ফ্র্যাংকেনস্টাইনের নিয়ন্ত্রণহীন দানবদের মতো।
ভারতের রয়েছে বহুদিনের পুরোনো বহুভাষী সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য। ৯০০ টিভি চ্যানেল রোজ কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বিভিন্ন খবরাখবর ও বিনোদন অনুষ্ঠান। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও সংবাদপত্র নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন তথ্য। অনেক দশক ধরে দেশটির স্বাধীন গণমাধ্যম সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি তুলে ধরে এবং দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল। কিন্তু গত এক দশক ধরে বিশেষ করে টিভি সংবাদের ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে।
দেশের সর্ববৃহৎ চ্যানেলগুলোর অনেকেই সরকারের বক্তব্যগুলোই প্রচার করে। সেটি তারা করে হয় আদর্শগত মিলের কারণে অথবা ওপরের মহলের চাপে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহ অথবা মানহানির অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এবং ট্যাক্স ফাঁকি বা অন্যান্য অভিযোগে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া মনিষা পান্ডে মনে করেন, অনেকে নিজের ব্যক্তিগত উন্নতির একটি সিঁড়ি হিসেবে এই পরিবর্তনের সুযোগকে ব্যবহার করছেন।
গত ৮ মে মধ্যরাতের কিছু আগে হিন্দিভাষী চ্যানেল দ্য পোস্টের এক সাংবাদিক কোনো সূত্র ছাড়া সহকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে জানান, ভারতীয় নৌবাহিনী একটি আক্রমণ পরিচালনা করার দ্বারপ্রান্তে। আরেকজন বলে ওঠেন, ‘করাচি’! ব্যস, কয়েক মিনিটের মধ্যেই চ্যানেলটিতে ছড়িয়ে গেল ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দর আক্রমণ করেছে। এই চ্যানেলের একজন কর্মী আক্ষেপ করে বলেন, চ্যানেলগুলোর গরম কল্পকাহিনি লেখকদের দখলে চলে গেছে।
অন্য একটি চ্যানেলের সাংবাদিক জানান, তারা খবরটি প্রচার করেছেন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়ার পর। এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মন্তব্য চেয়ে পাওয়া যায়নি। অন্যরা জানায়, ক্ষমতাসীন দলের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে খবরটি জেনে তারা প্রকাশ করেছেন। ইন্ডিয়া টুডের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক সোয়েতা সিং অন এয়ার ঘোষণা করেন, ‘করাচি ১৯৭১ সালের পর সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের সময় পার করছে। এটা পাকিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে শেষ করে দিচ্ছে।’ এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে ৯ মে সকাল ৮টায় করাচি পোর্ট ট্রাস্ট এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে, কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ভারতে কিছু হিন্দিভাষী পত্রিকা খবরটিকে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করে। বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেলে অবিরাম অসত্য খবরের ফুলঝুরি চলতে থাকে; এমতাবস্থায় কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাও এই মিথ্যার মহোৎসবে যোগ দেন। অবস্থা এতটাই চরমে পৌঁছায় যে, সরকার বাধ্য হয়ে টিভি খবরের মধ্যে বিমান হামলার সাইরেন বাজানো নিষিদ্ধ করে ঘোষণা দেন। কারণ এভাবে চলতে থাকলে জরুরি অবস্থার সময় মানুষ বুঝতে পারবে না, কোনটি আসল আর কোনটি চ্যানেলে বাজছে!
আজতাক নামে একটি হিন্দি চ্যানেলে টক শোতে একজন দর্শক প্রশ্ন করার সময় তার মাইক্রোফোন কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন যে, ‘আন্তর্জাতিক সমাজে আমরা আজ ভিত্তিহীন খবর পরিবেশনের জন্য যে অপদস্থ হচ্ছি...।’ আজতাকের পরিচালনা কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে মন্তব্য চেয়ে পাওয়া যায়নি।
ভারতীয় চ্যানেলগুলো যে কেমন আজগুবি খবর পরিবেশন করে চলে তা এখন সবাই জানি। তাই অনেকের কাছে ভারতীয় চ্যানেল বিশেষ করে গদি মিডিয়ার একটি এপিসোড মানে ব্যাপক বিনোদন। প্রসঙ্গত, সরকার সমর্থক চ্যানেলগুলোকে ভারতীয়রা নাম দিয়েছে ‘গদি মিডিয়া’।