
মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা নিয়ে যুদ্ধ চলেছিল কয়েক দিন। অবশ্য দ্রুত হারিয়ে গেছে বিষয়টি, কারণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম। এটা অবশ্য অনেকে মানতে চায় না। তবে যেকোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক পরিহার করাটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ক্ষমতাবানরা ১৯৭১ সালের পর থেকে যে বিতর্ক শুরু করেছে, যতদিন বাংলাদেশ আছে লাভ-ক্ষতি যাই হোক, চলতেই থাকবে। এর সঙ্গে যদি যোদ্ধাদের তালিকার যোগাযোগ না থাকে মানুষের আগ্রহ থাকবে কেন? এই বিতর্ক ওঠায় বিভিন্ন সরকার, ঝগড়া চিৎকার চলে, তারপর থেমে যায়।
শুধু তালিকাটা চলমান। বিভিন্ন সরকার নতুন করে তালিকা বানায়, কাউকে ফেলে, কাউকে রাখে। এটা চলতেই থাকবে। এবারে যুক্ত হলো নতুন মাত্রাÑফুল, হাফ, কোয়ার্টার মুক্তিযোদ্ধা। এই ঝগড়া কি আর থামবে? ভাগ্যিস পাবলিকের ইন্টারেস্ট এত কম একাত্তর নিয়ে।
দুই.
এসব সংজ্ঞা ও তালিকা তৈরি করে সরকার, জনগণ নয়। অতএব, তাদের আগ্রহ থাকবে কেন? সরকার মানে আমলাতন্ত্র তথা প্রাতিষ্ঠানিকতার অংশ-অর্থাৎ রাষ্ট্র, অর্ডিন্যান্স, আইন, সচিবালয়, বেতন, পদক ইত্যাদি। সব সরকার বা আমলাতন্ত্রের স্থায়ী চেহারা। আমাদের দেশে এর যাত্রা শুরু মুজিবনগর দিয়ে এবং চলছে বর্তমান ইউনূস নগর পর্যন্ত। প্রাতিষ্ঠানিকতার আমলা ভাবনাভিত্তিক সংজ্ঞা তো জনগণের সঙ্গে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে কি না একাত্তর অনেক মানুষের কাছে জনযুদ্ধ। নিয়মতান্ত্রিক বা সরকার পরিচালিত যুদ্ধ ছিল না। তবে এই যোদ্ধাদের বিভাজন খোদ ১৯৭১ সালেও ছিল মুজিবনগরের চোখে। যোদ্ধাদের দুই ভাগ ছিল, ‘এক. নিয়মিত বাহিনী, দুই. গণবাহিনী’। একটা অফিশিয়াল, অন্যটা জনসাধারণের।
এই বিভাজন হচ্ছে কার সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের সম্পর্ক কত কাছের, সেটা দেখানো। একদল রাষ্ট্রের যোদ্ধা আর বাকিরা সমাজের বা সাধারণ মানুষের যোদ্ধা। যোগাযোগ তো নিশ্চয় ছিল দুই এর মধ্যে, কিন্তু তারা এক ছিল না। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যটি অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের। একটি রাষ্ট্র, অন্যটি সমাজ। একাত্তরের যুদ্ধে সমাজের ভূমিকা ছিল অধিক, কারণ সবাই জড়িত ছিল, কেবল রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়। কেবল গোলাগুলির যুদ্ধ একাত্তর ছিল না। এটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্মুখযুদ্ধ নয়। কিন্তু এটা মেনে নিলে একাত্তরের ইতিহাস সবার হয়ে যাবে, যেটা করলে তো পাবলিকের দাম বেড়ে যায়। রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে কি এটা করা সম্ভব?
তিন.
অন্তর্বর্তী সরকার ফুল, হাফ, কোয়ার্টার মুক্তিযোদ্ধা কিসিমের ডিভিশন তৈরি করেছে কেন জানি না। তবে এটা প্রাতিষ্ঠানিক যুদ্ধের ধারণার সঙ্গে মেলে, সামাজিক জনযুদ্ধের নয়। একটা ঘটনা বলিÑশত্রু হত্যা না করলে কি যোদ্ধা হয়?
আমার এক বন্ধু যুদ্ধের শেষে বিব্রত ছিল, কারণ সে কাউকে হত্যা করেনি। আসলেই সবাই করেনি। তার ভাবনা, লোকে কী বলবে? তাই ধরে আনা এক রাজাকারকে চাকু মেরে হত্যা করে। শত্রু নিধন করতে হবে না যোদ্ধা হতে গেলে? অর্থাৎ ধারণাটা সনাতনী যুদ্ধকেন্দ্রিক, দেশের মুক্তিকেন্দ্রিক নয়।
তবে যৌথ বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার কি মনে হয় আমরা যৌথ বাহিনী বাংলাদেশ প্রবেশ করতে পারতাম, যদি সাধারণ মানুষ আমাদের ঢুকতে না দিত?’ মানে যুদ্ধের মূল অনুমতিদাতা সাধারণ মানুষ। যার সমর্থন ছাড়া যুদ্ধ বা বিজয় সম্ভব নয়। তাহলে এই পাবলিক কে? যে নিরস্ত্র, কিন্তু গোটা যৌথ বাহিনী রুখতে পারে? এটাই জনযুদ্ধের চিত্র চরিত্র। সে অস্ত্র না ধরলেও সবচেয়ে শক্তিশালী, এমনকি খোদ সেনাবাহিনীর চেয়ে। এই ভাবনার চর্চাটা আমাদের দেশে প্রায় নেই। আমরা হচ্ছি হয় সশস্ত্র, না হয় কেউ না।
চার.
আমি কেবল একাত্তরের গল্প বলতে আসি। তারা কে ফুল, আধা না কোয়ার্টার না অন্য কিসিমের যোদ্ধা, সেটা জানি না। ছোট্ট দুটি গল্প শোনাই।
শহীদ নামের এই ছেলেটার আসল নাম ছিল আমজাদ। কিন্তু সে সবার কাছে শহীদ নামেই পরিচিত। বলত, ‘দেশ তো স্বাধীন হবেই, কিন্তু তারপর যে কী হবে, কে জানে। আমি ওই সব দেখতে চাই না। আমি আগেই শহীদ হতে চাই।’ লোকে নাম জিজ্ঞাসা করলে বলত শহীদ। এর মধ্যেই এক ঘটনা ঘটে।
ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে একটু দূরেই ছিল রিফিউজিদের ক্যাম্প আর তার একটু দূরে নদী, যার অন্যদিকে ছিল একটা পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প। এই নদী দিয়ে রিফিউজিরা যখন আসত তাদের প্রথমে রাখা হতো রিসেপশন ক্যাম্পে। এদের অনেকে গুলিতে আহত-নিহত হতো ওই পাকিস্তানি মেশিনগানের গুলিতে। তাই সিদ্ধান্ত হয় ইন্ডিয়ান-বাংলাদেশি সেনাদের একটি দল নদী পার হয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করবে। আর অনেক রিফিউজি মানুষের একটা ‘হৈ হৈ পার্টি’ তৈরি করা হয় আওয়াজ করার জন্য, যাতে পাকিস্তানিদের মনোযোগ অন্যদিকে থাকে। এদের সঙ্গে জুটে যায় শহীদ। একটা টিলার ওপর উঠে প্রচুর আওয়াজ করতে থাকে সবাই, পাকিস্তানিদের দৃষ্টিও যায় ওই দিকে। কিন্তু একসময় সব নিরাপত্তার চিন্তা বাদ দিয়ে, কারো কথা না শুনে, টিলার মাথায় উঠে যায় শহীদ। তার হাতে দুটি বাঁশের লাঠি, সে বাজাতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে। পাকিস্তানিরা দূর থেকেও লক্ষ্য ভেদ করতে পারত, শহীদের বেলায়ও মিস হয়নি। এদিকে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ যৌথ অভিযান সফল। নদীর ওপারে পাকিস্তানি ক্যাম্প ফিনিশ। সব মিলিয়ে মারা গেছে মাত্র একজন, তার নাম শহীদ।
পাঁচ.
আরেকটি ছোট্ট গল্প। এক বয়স্ক গ্রামীণ মহিলা, যার ছেলে মারা গেছে রাজাকারের হাতে, ভিটা গেছে অন্য কারো হাতে, কিন্তু তিনি তবুও মাটি ছাড়েননি। গ্রামের একটু দূরে জলার টানায় থাকেন, হাঁস-মুরগি পেলে পেট চালান। তার বাসায় এক রাতে এক দল যোদ্ধা আসে। তিনি যোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, তার পেলেপুষে রাখা সব প্রাণী জবাই দিয়ে ওদের খাওয়ান, যেন তারা নিজের সন্তান। বাজারে গেলে তো মানুষ সন্দেহ করবে, তাই নিজেরগুলোই জবাই দেন। তিনি কি জানতেন না কী করছেন? তার পেট চলার পথগুলো বন্ধ হচ্ছে? এক রাতে তারা কাজ শেষে চলে যায়। যুদ্ধের পর ওই যোদ্ধা দলের দুজন ফিরে গিয়েছিল ওই নারীর খোঁজ নিতে, কৃতজ্ঞতা জানাতে। কিন্তু একটি শুকিয়ে যাওয়া লাশ ছাড়া কিচ্ছু পায়নি। তিনি কি যোদ্ধা ছিলেন? কেমন যোদ্ধা? হাফ, ফুল নাকি কোয়ার্টার? তবে এটাই আমাদের একাত্তর।
লেখক: সাহিত্যিক ও গবেষক