Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

চেঙ্গিস আর হালাকু খানের আবির্ভাব

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১৬:২৭

চেঙ্গিস আর হালাকু খানের আবির্ভাব


২১ জুন, ২০২৫ ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্রুত শান্তি না এলে তাদের বাকি টার্গেটগুলোতে নির্ভুল নিশানায় আবারও আঘাত হানার হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরান প্রতিশোধ নিয়েছে, তবে আগে অবহিত করেছে, পরে কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটিতে আক্রমণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঘাঁটি থেকে সব সরিয়ে নেওয়ার পর ইরান ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ফলে তাদের একটি সেনাও মরেনি।

যুদ্ধেও কূটচাল হয়, জয়-পরাজয় আপসে নির্ধারণ করা হয়। এটা বেশি হয় মল্লযুদ্ধে। ইরান যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে থাকতে চায় না তা যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রিম সতর্ক করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এমন হামলা ইরান আগেও চালিয়েছিল; ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর। কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছিল আমেরিকা, ইরান তখন বেকায়দায়, আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে নামা বোকামি। কিন্তু ইরানের জনগণ ও বিশ্বের অবুঝ মুসলমানদের উজ্জীবিত রাখতে আমেরিকাকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দেওয়া হলো। ঘোষণা দিয়ে গোপনে আমেরিকাকে জানিয়ে ইরাকের আমেরিকান ঘাঁটিতে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু আমেরিকার একটি সৈন্যও মরেনি, কেউ আহতও হয়নি। 

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করাই ছিল ইসরায়েল এবং আমেরিকার লক্ষ্য, তা পূরণ হওয়ার পর যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত না হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রথমে ইরান বন্ধ করবে, তার বারো ঘণ্টা পর ইসরায়েল বন্ধ করবে। ইরান বুদ্ধিমান, মেনে নিয়েছে। আর বেশিদিন যুদ্ধ চললে ইরানের অর্থনীতিও ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ায় মানসম্মান কিছুটা হলেও রক্ষা হলো।

কয়েক দিন আগে ট্রাম্প ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছিলেন, ‘ইরানিরা আত্মসমর্পণের জাতি নয়।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে তখন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে জড়ালে তারা যে ক্ষতির মুখে পড়বে তা পূরণ করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হবে না। বাহুবল না থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন বাগাড়ম্বর করে কয়েকটি দেশের শাসক নিজেদের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছেন। এদের মধ্যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মুয়াম্মর গাদ্দাফি, পাকিস্তানের ইমরান খান, পানামার ম্যানুয়েল নরিয়েগা, চিলির সালভাদর আলেন্দে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকেও হত্যা করার কথা একযোগে বলছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তিনি যে বাঙ্কারে লুকিয়ে আছেন তার খোঁজও নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জানা।

১৩ জুন, ২০২৫, শুক্রবার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও অস্ত্রাগারে হামলা চালায় এবং ইরানের ৯ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে। দুঃখজনক হচ্ছে, সেনাপ্রধানকে হত্যা করার পর ইরানের নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান আলি শাদমানিকেও ইসরায়েল হত্যা করেছে। শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হারিয়ে ইরান ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কিছুটা প্রতিশোধ নিয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এত শক্তিশালী যে, ইরানের নিক্ষিপ্ত শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে মাত্র কয়েকটি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে আঘাত করতে সমর্থ হয়, বাকিগুলো আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ইরানের যুদ্ধ বিমানের অবস্থা আরো খারাপ। এ জন্যই বোধ হয় সৌদি আরব, ওমান ও কাতারের মধ্যস্থতায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছিল ইরান, কিন্তু ইসরায়েল মানেনি। যুদ্ধ বন্ধ হলে ইরান পারমাণবিক আলোচনায় নমনীয় হতেও প্রস্তুত ছিল। 

ইরানের একেবারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার কৃতিত্ব ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর। মোসাদের গুপ্তচরেরা বহুদিন আগে ইরানে অনুপ্রবেশ করে মধ্য ইরানে ঘাঁটি গেড়েছিল। ইসরায়েল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসকারী প্রযুক্তি এবং তা দিয়ে ওই চরেরাই ধ্বংস করেছে ইরানের রাডারব্যবস্থা এবং অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ব্যাটারি। ফলে ইসরায়েলের বিমানগুলো বিনা প্রতিরোধে নির্বিঘ্নে-নিশ্চিন্তে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে পেরেছে। শুধু তা-ই নয়, কে কোথায় বাস করে তার নিখুঁত চিত্রও এঁকে নিয়েছিল মোসাদ, যার ফলে ইরানের সামরিক শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করতে একটুও বেগ পেতে হয়নি। ইরানের ভেতরে অবস্থান নিয়ে সুন্দরী নারী গোয়েন্দা দিয়ে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের সব গোপনীয় তথ্য নিয়ে নিল, কিন্তু ইরান মোসাদের হদিসও খুঁজে পায়নি। আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। যুদ্ধের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় ইসরায়েল ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা করে ধ্বংস করে দিয়েছিল, কিন্তু ইরাক ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি।  

নিহত বিজ্ঞানীরা ছিলেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল কারিগর। শুধু এবারই নয়, আগেও বহুবার ইসরায়েল ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। মাঝে মাঝে অচল করে দিয়েছে পারমাণবিক কেন্দ্রও। পরমাণু বিজ্ঞানী ও পারমাণবিক কেন্দ্রের ওপর যতবার হামলা হয়েছে ততবার কঠিন প্রতিশোধের শপথ নিয়েছে ইরান। কিন্তু ইসরায়েলের আগ্রাসন একটুও থামেনি। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের জনক মোহসেন ফাখরিজাদেহকে ২০২০ সালে হত্যা করা হলে ইরান ‘বজ্রপাতের’ মতো অপরাধীদের আঘাত করার ঘোষণা দেয়। ‘একটি বিপজ্জনক ক্যান্সারের টিউমার’ আখ্যায়িত করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসরায়েলকে উচ্ছেদ করা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে ইরান একমাত্র দেশ, যারা এতদিন ইসরায়েলকে শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি।  

ইরাকের ইরানঘনিষ্ঠ শিয়া মিলিশিয়া, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ, লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস ও ইয়েমেনের হুতিদের সম্মিলিত প্রতিরোধে ইরানের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যে যে অক্ষশক্তির উদ্ভব হয়েছিল তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে হুমকি তৈরি করত। কিন্তু ইসরায়েল সব সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে একা লড়েছে। ইরানকে নিষ্ক্রিয় করা গেলে বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সরব থাকার কোনো রসদ থাকবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মিলে ইরানকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ইরানের কোনো বন্ধু ঘোষণা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েও আবার পেছনে হটেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ডিনার করে ট্রাম্পকে শান্তির দূত হিসেবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত বলে মনে করেছেন। আজ ইরানও গাজার মতো নিঃসঙ্গ ও একা।  

চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। স্বাভাবিক হওয়ার আগে ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক ছিল সাপেনেউলে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ মুসলিম দেশ ইরানের পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়াকে মেনে নিতে পারেনি। দেশগুলোর ধারণা, পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবে উগ্র ইসলামপন্থার উদ্ভব হবে, রাজতন্ত্রের পতন ঘটবে। তাই সৌদি আরব একসময় চেয়েছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসরায়েল ধ্বংস করে দিক। ইরানের পারমাণবিক বোমা বা বোমা বানানোর জন্য অপরিহার্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ থাকলে আমেরিকা বোমা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ত। ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানোর সক্ষমতা নেই-এই কথাটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড ট্রাম্পকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ট্রাম্প মানেননি। অবশ্য মানার কথাও নয়, কারণ ট্রাম্প নিজেও জানেন যে, ইরান পারমাণবিক বোমার ধারেকাছেও নেই; কিন্তু ইরানকে তাদের ভয়ংকর মারণাস্ত্রের নিখুঁত প্রয়োগের বিধ্বংসী রূপ দেখানোর পরিকল্পনা ছিল, যাতে ইরান মৃত সাপের মতো সোজা থাকে।  

ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর সক্ষমতা ধ্বংস করতেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করেছে; অথচ এই দুটি দেশের কাছেই পারমাণবিক বোমা আছে। তাদের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকলে ইরানের কাছে কেন থাকতে পারবে না-এই কথার জবাব নেই। আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারমাণবিক বোমার প্রয়োগ করেনি, তার পরও কল্পিত পারমাণবিক শক্তিধর ইরানকে বিশ্বাস করা যায় না, বিশ্বাস করতে হবে হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংসকারী যুক্তরাষ্ট্রকে।  

তবে ট্রাম্পকে বিশ্বাস করা যায় না, কারণ তিনি যা বলেন, করেন তার বিপরীত। অবশ্য ইরানের রিজিম পরিবর্তনের পরিকল্পনা থাকলেও তা বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করার সুযোগ কম। কারণ যারা ইরানের ধর্মীয় স্বৈরশাসনের অবসান চায় তারা এখন নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিজ ও প্রিয়জনদের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। এ ছাড়া ইরানে গণতন্ত্র নেই, ইসরায়েলের ভেতর ইহুদিরাও ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে; কিন্তু ইরানে এমন বিক্ষোভ হলে সঙ্গে সঙ্গে ‘ইসরায়েলের চর’ আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে লটকিয়ে দেওয়া হবে। তবে শেষ পর্যন্ত ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হবে। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ফলাফল হচ্ছে প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া ভার্সাই চুক্তির মতো, যে চুক্তির অধীনে ইরানে কোনো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র থাকবে না।  

সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবী খ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসকদের পুঁজি ভেঙে যেদিন থেকে মুসলমানরা খেতে শুরু করল, সেদিন থেকে তাদের পতন শুরু হয়েছে। উদ্ভাবন ও সৃজনী শক্তি না থাকায় মুসলমানদের বাগাড়ম্বর বেশি। তাদের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার তাদের পরকালমুখী করে তুলেছে। মুসলিম রক্ষণশীলতার পুনর্জাগরণে সারা বিশ্বে তৈরি হয়েছে ‘ইসলাম ফোবিয়া’। ফলে সব ধর্মাবলম্বীর কমন শত্রু মুসলমান। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু হলো একটি ৪৬ বছরের পুরোনো, জীর্ণ ও নড়বড়ে হেলিকপ্টারে চড়ার কারণে। তার পরও ইরানকে স্যালুট, সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের বর্বরতা থামানোর জন্য ইরান তার সীমিত শক্তি দিয়ে লড়াই করেছে। ইরান নব্য হালাকু খানদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে নিঃসঙ্গ হয়ে একাকি লড়ে গেছে, এই লড়াই পরাজয়ের নয়। 


 লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক 



Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫