-685fd134bdfca.jpg)
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। এই ভাষণে তিনি কিছু অপপ্রচার নাকচ করে দিয়ে নিশ্চিত করেছেন-এগুলো শুধুই অপপ্রচার। এর মধ্যে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, একটি হচ্ছে টেকনাফের মানবিক করিডর, অন্যটি চট্টগ্রাম পোর্ট বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া।
যে কথাটি অর্ন্তবর্তী সরকার প্রধানের মুখ থেকে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল রাজনৈতিক দলগুলো, বক্তব্যের প্রায় শেষের দিকে এসে তিনি বেশ নাটকীয়ভাবেই তা প্রকাশ করেন। টিএস এলিয়ট তার বিখ্যাত কবিতা দ্য ওয়েস্টল্যান্ডে ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’ বললেও আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসেই জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ড. ইউনূস ঘোষণা করেন। আরো সুনির্দিষ্ট করে তিনি এপ্রিলের প্রথমার্ধ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পারেননি যে ড. ইউনূস নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ‘ডিসেম্বর থেকে জুন’ ঘোষণা করেছিলেন সেখান থেকে কোনো নড়চড় হবে না, তিনি তার প্রতিশ্রুতি কখনোই ভঙ্গ করবেন না। যে কারণে প্রথমে জুনের মধ্যে, আবার কখনো তিন মাসের মধ্যে এবং পরে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ইত্যাদি বলে সরকারকে একটা নির্বাচনী চাপের মধ্যে রাখতে চেয়েছিল তারা।
বিএনপির প্রচুর কর্মী আছে, কারণ বাংলাদেশের মানুষ মূলত ন্যাশনালিস্ট এবং ভারতবিরোধীÑএই ভাবধারার দল হিসেবে বিএনপির প্রতি দেশের মানুষের একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। যার প্রমাণ হলো গত ১৭-১৮ বছর ধরে তারা সঠিক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারেননি। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন যোগ্য নেতা ছিলেন, যে কারণে এটি একটি বড় দল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তার মানে তো এই নয় যে জিয়াউর রহমানের পুত্ররাও তার মতো যোগ্য নেতা হবেন। তাহলে তো রবীন্দ্রনাথের ছেলে রবীন্দ্রনাথ হতো, সক্রেটিসের ছেলে সক্রেটিস হতো, ম্যান্ডেলার ছেলে ম্যান্ডেলা হতো, ওবামার মেয়ে ওবামা হতো। নেতৃত্ব কোনো বংশানুক্রমিক বিষয় নয়। এ কারণেই রাজতন্ত্র পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আপনাকে দেশের সবচেয়ে যোগ্য মানুষটিকেই দেশের নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে, দলের সবচেয়ে যোগ্য মানুষকেই দলের নেতৃত্ব দিতে হবে। তা না হলে দল কিংবা দেশ কোনোটিই এগোতে পারবে না।
শুধু একটি পরিবার থেকেই নেতা আসতে হবে, এ রকম একটি অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং বলা যায় এটিই হয়ে উঠেছে বিএনপিসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের অলিখিত গঠনতন্ত্র, যা দিয়ে আজকের প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে খুব বেশি দূর এগোনো যাবে না এবং এসব দলের প্রতি মানুষের সমর্থন অব্যাহত থাকলে দেশও ক্রমে পিছিয়ে পড়বে। বিএনপি পরিবারতন্ত্রের এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, দলটি আস্তে আস্তে মিইয়ে যাবে। এখন তো তথ্য মানুষের হাতের মুঠোয়, যদি দেশে ভোটের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়, তাহলে পরিবারতন্ত্রের বিনাশ নিশ্চিত।
এখন আমি কট্টর দেশপ্রেমকেও ভয় পাই, এতে করে মানুষের সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি বেরিয়ে পড়তে পারে। জাতীয়তাবাদ মানুষকে অতিমাত্রায় যুক্তিহীন, দেশপ্রেমিক করে তোলে, যা বিশ্বমানবতার জন্য ক্ষতিকর। বিএনপির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের যে বিপুল সমর্থন এটি দেশের গণতন্ত্র বিকাশে কাজে লাগুক, এটি আমি খুব চাই, তাই জাতীয়তাবাদী এই শক্তিকে ত্রুটিমুক্ত করাই আমার মূল লক্ষ্য।
এবার আসি যে কথা বলার জন্য এই লেখার অবতাড়না, সেই জায়গাটিতে। আগামী এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচন। আমরা নিশ্চিত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। এপ্রিলে নতুন সরকার গঠিত হবে। সেটি হবে দলীয় রাজনৈতিক সরকার। দেশের অবস্থা আবার আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলের মতো হয়ে যাবে-এই আশঙ্কা আমি করছি না। তবে বর্তমান সরকারের চেয়ে যে আবারও কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নির্বাচনের আগে যে ৯ মাস সময় আছে, এই সময়টাতে দেশে কিছু সাংস্কৃতিক পরিবর্তন তৈরির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। ব্রিজ, কালভার্ট, সরকারি প্রতিষ্ঠান/প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী, এমপিরা-এটিই আমরা দেখে এসেছি। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টারা তা করছেন না, এটি একটি বড় পরিবর্তনÑএই পরিবর্তনকে সাধুবাদ জানাই। আপনারা আরেক ধাপ এগিয়ে যান। দেশের বিশিষ্ট মানুষদের সম্মান জানান। দেশের গুণী লেখক, কবি, সাংবাদিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সৎ মানুষ, শিক্ষক, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের দিয়ে এসব উদ্বোধন করান। সঙ্গে উপদেষ্টারাও থাকেন। দেশের মানুষকে বুঝতে দিন একজন সৃজনশীল মানুষ, একজন সংগীতশিল্পী, একজন পটুয়া, একজন সৎ স্কুল শিক্ষকের মর্যাদা অনেক ওপরে। এভাবে সম্মান জানানোর প্যারাডাইমটা শিফট করে দিন। একটি নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটান। তাহলে মানুষ বৈধ-অবৈধ উপায়ে মরিয়া হয়ে অর্থবিত্ত অর্জনের চেয়ে সততা, সৃজনশীল প্রতিভা এবং মানবিক গুণাবলি বিকাশে অধিক মনোযোগী হবে, জাতি হিসেবেও আমরা অনেক ওপরে উঠে যাব।
লেখক : কবি ও জাতিসংঘে কর্মরত