Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ব্যক্তিগত আত্মরক্ষায় আইনি সীমা

Icon

লোকমান হাওলাদার

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১৮:৪৮

ব্যক্তিগত আত্মরক্ষায় আইনি সীমা

প্রতীকী ছবি।

নিজেকে, নিজের পরিবারকে এবং সম্পদ রক্ষা করা একজন নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এ অধিকারই ‘ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা’ বা রাইট টু প্রাইভেট ডিফেন্স নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এই অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে এই অধিকার চর্চার রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু সীমা, নিয়ম ও শর্ত। অন্যথায় আত্মরক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময় কেউ অপরাধী হয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৯৬ থেকে ১০৬ ধারা পর্যন্ত আত্মরক্ষার অধিকার ও তার আইনি সীমারেখা নিয়ে পরিষ্কার বিধান রয়েছে। এই ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে কেউ কিছু করলে তা সব সময় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না, তবে তা হতে হবে যুক্তিসংগত ও প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি অনুযায়ী।

দণ্ডবিধির ৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ নিজের বা অন্য কারো জীবন, শরীর কিংবা সম্পদ রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক কোনো কাজ করেন এবং সেটি যুক্তিসংগত মাত্রায় হয়, তাহলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। ৯৭ ধারায় বলা হয়েছে, নিজের পাশাপাশি অন্যের জীবন ও সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রেও এই আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যাবে।

তবে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে সীমা টেনে দেওয়া হয়েছে ৯৯ ধারায়। এতে বলা হয়েছে, যদি কারো প্রতিরোধমূলক আচরণ একটি বৈধ সরকারি দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ বা কর্মচারীর কাজকে বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে, যদি না প্রমাণ করা যায় যে সরকারি কর্মকর্তা তার দায়িত্বের সীমা লঙ্ঘন করেছেন।

আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ১০০ ধারা। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ হত্যা, ধর্ষণ, গর্ভপাত করানো বা গুরুতর শারীরিক ক্ষতির মতো ভয়ংকর অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করে, তাহলে আত্মরক্ষায় আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটলেও সেটি অপরাধ হবে না। এর পাশাপাশি ১০৩ ধারায় বলা হয়েছে, যদি চুরি, ডাকাতি, জোরপূর্বক প্রবেশ বা অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের সময় কোনো ব্যক্তির জান-মালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে, তখন আত্মরক্ষায় মারাত্মক প্রতিরোধ বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

তবে এ অধিকার ‘উন্মুক্ত’ নয়। আত্মরক্ষার অধিকার মানে এই নয় যে কেউ প্রতিশোধ নিতে পারবেন। আইন পরিষ্কারভাবে বলছে, পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলে অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করলে, সেই প্রতিরোধ আর আত্মরক্ষা থাকে না, সেটা তখন আইনত অপরাধে রূপ নেয়। প্রতিটি পরিস্থিতিতে ‘আত্মরক্ষা’ ও ‘আক্রমণ’ এই দুইয়ের পার্থক্য আইনি ভাষায় প্রমাণ করতে হয়।

এই বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সম্প্রতি। দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি বা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এখন অনেকেই ভাবছেন, এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের সুরক্ষায় কী করা যায়? এসব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার আইনসম্মতভাবে প্রয়োগ করলে তা বৈধ। তবে প্রতিটি ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট বিচার করে তবেই সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় যে প্রতিরোধ বৈধ ছিল কি না। 

আত্মরক্ষার অধিকার যেমন অপরিহার্য, তেমনি এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে। কেউ যদি আত্মরক্ষার নামে বেআইনি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তিনি শাস্তির আওতায় আসতে পারেন। আবার ভয় বা দ্বিধায় পড়ে যদি কেউ আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ না নেন, তাতেও বড় ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, আত্মরক্ষা করা একজন নাগরিকের অধিকার, তবে তা কখনোই সীমাহীন নয়। এই অধিকার প্রয়োগে থাকতে হবে যুক্তিবোধ, পরিস্থিতি মূল্যায়নের ক্ষমতা ও আইন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান। আইন জানা মানে শুধু নিজের অধিকার চেনা নয়, সেই অধিকার কোথায় শেষ হয়, সেটাও জানা। আত্মরক্ষার আড়ালে অপরাধ নয়, সত্যিকার আত্মরক্ষাই হোক একজন নাগরিকের সচেতন প্রতিরোধ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫