
২৮ মে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) তারুণ্যের সমাবেশ ছিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনের সামনের রাস্তায়। চতুর্দিকের রাস্তায় যানজটে মানুষের ভোগান্তির ক্ষোভ আর আক্ষেপের কথা নাইবা বললাম। কেন্দ্রীয় অফিসের নিচে ক্রেস্ট আর ফটো দিয়ে সাজানো কক্ষটিতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের ৩১ দফার একটি বই পাওয়া যাবে? আমি টাকা দিয়ে কিনে নেব। একজন বললেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে ৩১ দফার বই ছাপাইনি।’
বিএনপি ৩১ দফার বয়ান নিয়ে কত না বক্তৃতা করেছে। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য, উন্নত করার জন্য, ৩১ দফা বলে মুখে ফেনা তুলেছে। অথচ তাদের কোনো জনসভা বা কর্মিসভায় বই, লিফলেট বা বুকলেট জাতীয় কিছু চোখে পড়ে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এর একটি ছাপানো কাগজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। রাস্তায় বইয়ের দোকানে বা বিএনপির কোনো অঙ্গসংগঠনের কর্মিসভায়ও পাওয়া যায় না। এ রকম দলীয় কর্মসূচির ছাপানো বই, পুস্তক লিফটেড তো বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা রাস্তায়, জনসভায় বা প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে জনগণের মাঝে বিলি করবেন। এমনটাই তো একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হওয়া উচিত। ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী বন্ধু, যিনি আবার যুবদল নেতাও, তার কাছে ৩১ দফা কোথাও খুঁজে না পাওয়ার আক্ষেপ জানানোর পর তিনি বললেন, একটি বই দেবেন। কিন্তু সেটাও আর পাওয়া গেল না। অবশেষে এক সম্পাদক বন্ধুর কাছে এটা জানানোর পর তিনি বললেন, তার কাছে বইটি আছে। তিনি একটি সেমিনারে গিয়ে বইটি পেয়েছেন, যা আমাকে দেবেন।
বললাম, আমাকে দেওয়া তো বড় কথা নয়। যে জনগণের কল্যাণের জন্য ৩১ দফার ঘোষণা হলো, সেই জনগণ কোথাও এটি দেখেনি। বিএনপির নেতাকর্মীরা ৩১ দফার একটি দফাও জনগণের সামনে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করছেন না অথবা করতে পারছেন না। শুধু বলেছেন আমাদের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন। এতটুকুই।
২৮ মে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে ক্রেস্ট আর ফটোর দোকানে দেখলাম পাঁচ-ছয়টি বই আছে। ‘স্বাধীতার ঘোষক জিয়া’ বইটি ৩৫০ টাকা দিয়ে খরিদ করলাম। বিক্রেতার নাম-পদবিসহ স্বহস্তে লেখা মূল্য এবং দলীয় পদবির ভিজিটিং কার্ড দিয়ে পিনআপ করে দিয়েছেন। আমার বড় আফসোস, দেশের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় অফিসে দলের কর্মসূচির একটি ছাপানো কাগজও নেই। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির জন্ম। বিএনপির বয়স এখন অর্ধ শর্তাব্দীর একটু কম। দলের প্রতিষ্ঠালগ্নে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি দেশের মানুষের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, আজকের ৩১ দফা তার ধারেকাছেও নেই।
জিয়ার ১৯ দফার এক দফা ছিল খাল কাটা কর্মসূচি। সেই কর্মসূচি দেশের খাদ্য উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। অর্ধ শতাব্দী আগে কর্মসূচির পুস্তিকা, লিফলেট, মাঠেঘাটে-হাটবাজারে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হতো। অথচ আজকের ৩১ দফার একটি বই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। জিয়ার বিএনপি আর আজকের বিএনপির মধ্যে কত ফারাক। জিয়ার সততা, নৈতিকতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল এক অনন্য উচ্চতায়।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে-রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় জিয়া একবার স্থলপথে সিলেট যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে রাষ্ট্রপতির গাড়ির সামনে একটি সাজানো বিয়ের কার বর নিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে অন্য একটি গাড়িতে বরযাত্রী। সিকিউরিটি টিম বিয়ের কারটিকে রাস্তার এক পাশে সাইড করার জন্য বললেন, জিয়া বিষয়টি লক্ষ করলেন। জিয়া নিজের গাড়ি থামিয়ে নামলেন। বরের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আদেশ দিলেন আমাদের যত গাড়ি আছে, সব বরের গাড়ির পেছনে থাকবে। বরকে বললেন আপনি হচ্ছেন আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমি না! বরের গাড়ি যতদূর পর্যন্ত গেছে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর পেছনে ছিল। এই হচ্ছেন জিয়া।
ফেনীতে জনসভা করবেন। ফেনীর প্রশাসন থেকে জানতে চাওয়া হলো স্যার, আপনার জন্য খাওয়ার কী ব্যবস্থা করব? খাওয়ার মেনু জানতে চাইল। উত্তর দিলেন, আমি পুলিশ লাইনের মেসে খাব। বাড়তি কিছু করবেন না। আজকের বিএনপির নেতাকর্মীদের আমলনামা আর কাণ্ডকীর্তন জিয়ার সেই বিএনপির সঙ্গে মেলে কি?
নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন দিয়ে তিন মাইল অবধি হরেক কিসিমের প্রচারণার মাধ্যমে নিজেকে নেতা হিসেবে জাহির করছেন। দলীয় কোনো উপলক্ষ এলে কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত শুভেচ্ছা, অভিনন্দন জানিয়ে রাস্তাঘাট ও দেওয়াল ভরিয়ে দিচ্ছেন প্রচারণার বাহারি রঙে চিত্রিত করে। সেই পোস্টারে জিয়া, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এখন আবার কোথাও কোথাও জুবাইদা রহমানের ছবিও দেওয়া হচ্ছে। নিজেকে নেতা হিসেবে পরিচিত করানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের রাজনীতিতে চলমান রয়েছে। সেই ব্যাধি থেকে বিএনপিও মুক্ত না, বরং এগিয়ে।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপির ওপর জুলুম-নির্যাতনের অবর্ণনীয় ভোগান্তি দেশবাসী দেখেছে। কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে পোস্টার-ব্যানারের যে ছড়াছড়ি, দেখে আমার মনে হতো এত প্রচার-প্রচারণার টাকা কোত্থেকে আসছে। এই হিসাব দুদক নিলেও নিতে পারত বা পারে।
শুধু বিএনপি কেন? অন্য দলগুলোও এভাবে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নেতার পরিচিতি পাওয়ার জন্য পোস্টার-ব্যানার দিয়ে প্রচারণা চালান। অথচ দলীয় আইকন জিয়াউর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি ভালো বই পাওয়া যায় না। যৎসামান্য যা কিছু পাওয়া যায় তা কিন্তু বিএনপির কোনো নেতার লেখা নয়। বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের কয়েকজন একটু-আধটু লিখেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা এসব জানেনই না।
বিএনপির রাজনৈতিক পথচলা প্রায় অর্ধ শতাব্দী। এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম বা নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিবরণের তথ্য উপাত্তভিত্তিক কোনো ঐতিহাসিক দলিল কোথাও খুঁজে পাই না। সাহিত্য সংস্কৃতিতে এত পিছিয়ে যে আমাদের আগামী প্রজন্ম বিএনপিকে মূল্যায়নের কোনো ইতিহাস পড়তে পারবে না। বিষয়টি বিএনপি নেতৃত্ব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করলে আমরা খুশি হব।
লেখক : আইনজীবী