Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

হয়তো পরিবর্তনের সুবাতাস!

Icon

কাজী সানজীদ

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৩:১৫

হয়তো পরিবর্তনের সুবাতাস!

দ্বতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমেছিল ১৯৪৫ সালে। সেই সঙ্গে পতন হয়েছে অক্ষশক্তির। ফলে মানুষ ভেবেছিল পৃথিবীতে হয়তো শান্তির যুগ শুরু হলো!

ধারণাটি ছিল ভুল।

মানুষের আজন্ম স্বভাব; অন্যকে পদানত করে রাজত্ব করা। অক্ষশক্তির পতনের সঙ্গে সঙ্গেই উত্থান হয়েছিল মার্কিন পরাশক্তির, যারা সারা বিশ্বকে শাসন করতে চায়। তা করার জন্য যত রকমের ব্যবস্থা প্রয়োজন, ইতিবাচক বা ধ্বংসাত্মক সব ধরনের পদক্ষেপ তারা নিয়ে আসছে ৮০ বছর ধরে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপান যখন আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রস্তুত, তদুপরি তাদের ওপর সভ্যতা ধ্বংসকারী বিজ্ঞানের কলঙ্ক আণবিক বোমা বর্ষণ করা হয়। উদ্দেশ্য, রাশিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়া-দেখ, আই অ্যাম দ্য বস। 

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী খবরদারি সহজেই চালিয়ে যেতে পারছে মূলত তার চারটি প্রধান সুবিধার কারণে :

*যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রান্তে দুটি মহাসাগরের উপস্থিতি,

*দেশের ভেতর সম্পদের প্রাচুর্য

*আশপাশে বিরক্ত করার মতো প্রতিবেশীর অনুপস্থিতি

 *বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের আধিপত্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র অসংখ্য যুদ্ধ করেছে এবং করছে হয় সরাসরি অথবা প্রক্সির মাধ্যমে। বলা যায়, ৮০ বছর ধরেই তারা কোথাও না কোথাও যুদ্ধ করছেই। উদ্দেশ্য সেই, প্রভুত্ব বজায় রাখা। পূর্বে এই বিশ্ব পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ব্রিটিশ কলোনি দেখেছে। ইউরোপীয় ওই দেশগুলোতে সম্পদের ব্যাপক ঘাটতি ছিল। সে কারণে তারা শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে বিশ্বব্যাপী ডাকাতি করে সম্পদ লুণ্ঠন করে বেড়াত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তো সম্পদের ঘাটতি নেই। তথাপি মোড়লগিরি ফলাতে এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে তারা সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সদা তৎপর। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে তারা প্রায় শতভাগ সফল।

তবে সব অপশক্তিই একদিন অস্তাচলে যায়। শ্যাম চাচার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই দেখা যাচ্ছে। ১৯৪৮ সাল থেকে চাচাজি অপকর্মের সার্বক্ষণিক সাথি হিসেবে পেয়ে যায় ইসরায়েল নামের এক রাষ্ট্রকে। পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে বলতে গেলে জোর করে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিল ১৯৪৮ সালের মে মাসে। একই মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। তারপর থেকে এই রাষ্ট্রটি হয়ে ওঠে এক ভয়াবহ দানব, যা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থনে ভূমি দখলের জন্য অসংখ্য যুদ্ধ করেছে। সব যুদ্ধেই তারা বিজয়ী হয়েছে এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা শ্যাম চাচার সরাসরি সমর্থন পেয়েছে। তার সহযোগিতায় সামরিকভাবে ইসরায়েল হয়ে উঠেছে অজেয়। অনেকের ধারণা ব্রিটেন অথবা ফ্রান্স থেকেও তাদের সামরিক শক্তি বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সব অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যা মার্কিন সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী ব্যবহার করে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে একমাত্র ইসরায়েল ব্যবহার করে। তাই তাদের ধারণা হয়েছিল, তাদের হারানোর মতো কেউ নেই এবং তারা মধ্যপ্রাচ্যে যা খুশি তাই করতে পারে। করেছেও তাই ৬০ বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা হয়ে উঠেছিল দুর্ধর্ষ অজেয় শক্তি।

তবে সবকিছুই একদিন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। অজেয় ইসরায়েলও সম্ভবত তার মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় হওয়ার ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, এই অবস্থাটি মানুষকে অন্ধ বানিয়ে ফেলতে পারে। ইসরায়েল এতদিন মনে করেছে আমরা শুধু অন্যকে আক্রমণ করেই যাব, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাবÑআমাদের থামাবে কে! শ্যাম চাচা তো পেছনে আছেনই। সব পরাশক্তিই এই ভুলটি করে।

সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী নৌ ও বিমানবাহিনী। চীন ও রাশিয়া অনেক আগেই বুঝে গেছে সমপর্যায়ের বাহিনী নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে পারব না। তাই তারা সেগুলোকে মোকাবিলা করার অস্ত্র তৈরির দিকে মন দিয়েছে এবং যা করা যায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম খরচে। ১০০ কোটি ডলারের একটি বোমারু বিমানকে ধ্বংস করতে প্রয়োজন হয়তো তিন লাখ ডলারের একটি ক্ষেপণাস্ত্র। অথবা হাজার কোটি ডলারের একটি বিমানবাহী রণতরিকে ডোবাতে প্রয়োজন সর্বোচ্চ দুটি ২০ লাখ ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র।

রকেট বিজ্ঞানে রাশিয়া ঐতিহ্যগতভাবে উন্নত। তারা রকেট আগে বানিয়েছে, মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছে প্রথম। এই বিজ্ঞানে তারা এগিয়ে থাকাতে শ্যাম চাচাও ইউক্রেন যুদ্ধের আগ পর্যন্ত  তাদের নভোযান উৎক্ষেপণের জন্য রুশ রকেট ব্যবহার করতেন। এই জ্ঞানের ওপর ভর করেই রাশিয়া বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়েছে। সেগুলো মার্কিন বিমান ও নৌ আক্রমণ রুখে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। শুধু তাই নয়, পাল্টা আক্রমণের জন্য তারা বানিয়েছে সুপারসনিক ও হাইপারসনিক দূর পাল্লার নিখুঁত লক্ষ্যভেদী ক্ষেপণাস্ত্র, যা প্রতিরোধ করার সামর্থ্য শ্যাম চাচার নেই। এই প্রযুক্তি রাশিয়া নির্ভরযোগ্য মিত্রদের সঙ্গে শেয়ার করেছে। যেমনÑচীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরান। এই দেশগুলোও এখন এসব মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী।

ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার কুড়ি বছর ধরে গড়ে তুলেছে মূলত নিজস্ব বিজ্ঞানী, প্রযুক্তি ও রাশিয়ার সহযোগিতায়। তাদের এ ভান্ডারটি বিশাল ও বৈচিত্র্যে ভরপুর এবং তা বহিঃশত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হওয়া অসম্ভব। সেগুলো রয়েছে মাটির অনেক গভীরে অজানা সব ভান্ডারে। তবে তারা কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাশিয়ার তাগাদা অগ্রাহ্য করেছে। সেটি তাদের ভুলও ছিল আবার সঠিক সিদ্ধান্তও ছিল। ভুল এ কারণে, এবারের যুদ্ধে ইসরায়েলি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান আক্রমণে তাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আবার সঠিক এ কারণে, বেশির ভাগ সম্পদ তারা অসংখ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের কাজে লাগিয়েছে। সেই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তারা ইসরায়েলের ভেতর যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা নজিরবিহীন। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল সিরিয়া ও লেবাননে যখন খুশি বিমান হামলা চালিয়ে অনেক সম্পদ ধ্বংস করেছে, বিনিময়ে তাদের কেউ প্রত্যাঘাত করতে পারেনি। এবার ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা করে ভেবেছিল আগের মতোই একতরফা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারবে। কিন্তু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি যে এই পর্যায়ে পৌঁছেছে তা ছিল মোসাদের কাছে অজানা। সেদিন ইউটিউবে একটি ভিডিওতে দেখলাম, তেল আবিবের মেয়র মোসাদের কর্মকর্তাকে এই বলে গালমন্দ করছেন, তোমরা কি খবর নিয়েছ? ইরানি মিসাইলের আঘাতে আমার সাজানো নগরী তো একেবারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই ইরান এই যুদ্ধে নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প সাহেবকে কার্যত নতজানু করে ফেলেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, ইরান একা লড়েছে দুটি বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে। প্রমাণ করে দিয়েছে, ইসরায়েল অজেয় নয়। এখন থেকে হয়তো ইসরায়েলের স্বেচ্ছাচারিতা কমে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার উৎসাহ তৈরি হবে, ধ্বংসযজ্ঞের কি বিভীষিকা তাও হয়তো ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ বুঝতে শিখবে এবং তারা লিবারেল রাজনীতিকদের ভোট দেবে। এও মনে হচ্ছে, সম্ভবত নেতানিয়াহুর পলিটিকাল ক্যারিয়ারের অবশেষে যবনিকা হতে চলেছে। 

শ্যাম চাচাও পূর্বে যেভাবে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে, ভবিষ্যতে হয়তো এ ধরনের অভিযান চালানোর আগে বহুবার চিন্তা করবে।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫