আমাদের নিশ্চিন্ত বসে থাকার সুযোগ নেই: মুশতাক হোসেন

মাহফুজউল্লাহ হিমু
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১৯:১১

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন
চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়ে শঙ্কিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি জানিয়েছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন এলাকায় ডেঙ্গুর হটস্পট গড়ে উঠেছে।
এই বিশেষজ্ঞের মতে ডেঙ্গুর মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করাটা শুধু উদ্বেগের নয়, সমন্বয়হীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে। তিনি মনে করেন, কেবল হাসপাতালনির্ভর ব্যবস্থায় ডেঙ্গু রোধ সম্ভব নয়—এর জন্য দরকার কমিউনিটি পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা ও মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সমন্বিত প্রয়োগ।
বিদেশি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নেই নিয়মিত নজরদারির ব্যবস্থা করার সুপারিশও করছেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় কতটা জটিল?
এখন পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান বা প্রবণতা তাতে বলা যাবে না আগের থেকে বেশি হবে কি না। যদিও যতটুকু হয়েছে তা উদ্বেগজনক। গত বছরের এই সময় যত রোগী ও মৃত্যু ছিল বর্তমানে এলাকাভেদে তার থেকে কম বেশি দেখা যাচ্ছে।
দক্ষিণাঞ্চলে গত বছর যা ছিল তা থেকে বেড়েছে। ঢাকায় অবশ্য গত বছরের তুলনায় কমেছে। এবার নতুন নতুন এলাকায় ডেঙ্গুর হটস্পট দেখা যাচ্ছে। ফলে আমাদের নিশ্চিন্ত বসে থাকার সুযোগ নেই।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কোন কারণগুলো দায়ী?
প্রথম থেকেই আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা গতানুগতিক কাজ করে যাচ্ছে। এটি করে আমরা কিছু ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করতে পারব, কিছু সময়ের জন্য মশা কমে যাচ্ছে এবং ফের তা বেড়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দরকার সমন্বিত জনস্বাস্থ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং কমিউনিটি ভিত্তিক মশক ব্যবস্থাপনা। কিন্তু আমরা এই দুটির দিকে যাচ্ছি না।
সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কি যথেষ্ট? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ পরিচালনা করতে না পারাকে কীভাবে দেখেন?
রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা তাদের অপারেশন প্ল্যান না থাকায় জরিপ করতে পারেনি। অপারেশন অর্থ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার আইইডিসিআরকে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সার্ভেইলেন্সের জন্য বাজেট রয়েছে, এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ দিয়েছে।
আইইডিসিআর মে মাসেও জরিপ করেছে। এখন তার নমুনা জরিপ করছে। সরকার করেনি এই কথাটা ঠিক নয়, আইইডিসিআর করেছে। আইইডিসিআরের কাজই জরিপ করা। জরিপ তো হয়েছে, এখন সেটা কতটা কাজে লাগানো গেল তা অপেক্ষা করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা এবং কমিউনিটিভিত্তিক মশক নিয়ন্ত্রণ সেটা কতটা করা এগুলো তা দেখার বিষয়।
ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে—কিন্তু কেন?
বরিশাল বিভাগে এবার অবস্থা বেশি খারাপ। সেখানে পরিস্থিতি খারাপ হবে তা আইইডিসিআরের ফেব্রুয়ারি মাসের জরিপেই উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে তা ফের উঠে এসেছে।
শুধু বরিশাল না, কুমিল্লা মাগুরা, বরগুনায় ব্রুনো ইনডেক্স বেশি পাওয়া গেছে। মাগুরায় তা ছিল ৬০। ফলে আমাদের শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক না, সারা বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমরা শুধু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ নিয়ে কাজ করেছি। তা যথাযথ নয়।
একই সময় করোনার সংক্রমণও কিছুটা বাড়ছে—এই দুটি রোগ একসঙ্গে মোকাবেলায় কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
শুধু এই দুটি না, অনেকগুলোই একসঙ্গে মোকাবিলা করা যায়। এর জন্য প্রথামিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা করতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। এর ব্যবস্থাপনা বরং আমাদের জন্য সহজ ও অধিক বৈজ্ঞানিক। কেননা আমরা একটা মহামারী মোকাবিলা করেছি। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এর সেবা বিস্তৃত ছিল।
এর জন্য আমাদের যা দরকার তা হলো, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা। আর এটি শুধু উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত থাকলে হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আগে হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। হাসপাতালে প্রবেশ করা প্রত্যেককে মাস্ক ও হাত ধুয়ে ঢুকতে হবে। তাহলে অন্যরাও সচেতন হবে। সরকারকে তা করে দেখাতে হবে। শুধু গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে এটি বাস্তবায়ন করা যাবে না।
নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ আছে কি?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু ২০২০ বা ২০২১ সালের মতো ঝুঁকি নেই। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশগুলোতেও বেড়েছে। তাই বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। গত বছরেও এই সময় কিছুটা বেড়েছিল। হয়ত মৃত্যুটা এমন ছিল না, এবার কিছুটা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হয়ত ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে। অথবা যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের পরীক্ষা করে ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। এ সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও বাড়ছে। এই বিষয়গুলো আমাদের নজরে রাখতে হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি এবং স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো কতটা প্রস্তুত?
টিকার ক্ষেত্রে আমাদের আগের কাঠামো ঠিক আছে। যারা প্রশিক্ষিত ছিল তাদের সরকার পুনরায় কাজে লাগাতে পারে। যারা অধিক ঝুঁকিতে আছে প্রথম তাদের টিকা দেবে এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের দেবে।
ডেঙ্গু ও করোনা মোকাবেলায় করণীয় কী?
জনস্বাস্থ্য ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানে তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা। যেখানে মানুষ এসে পরামর্শ নেবে। সেখানে ডাক্তার ও ল্যাব নাও থাকতে পারে, স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে সে তার নমুনা দেবে। নমুনাটা নিয়ে যেন ল্যাবে পরীক্ষা করে ওইদিনের মধ্যেই ফলাফল দেওয়া যায়। সেই ব্যবস্থা থাকলে রোগী- বিশেষ করে যারা দরিদ্র মানুষ তারা যেন সরকারি সেবাটা নামমাত্র মূল্যে নিতে পারে। যত বেশি শনাক্ত করা যাবে আমরা ভুক্তভোগীর সংখ্যা তত কমাতে পারব। শনাক্ত হলে সেই ব্যক্তি ধনী বা দরিদ্র, যাই হোক সতর্ক হয়ে যাবে।
হাসপাতালে যদি পর্যবেক্ষণের জন্য কাউকে ভর্তি করার প্রয়োজন হয় তাহলে তা করার সুযোগ থাকতে হবে। কেউ যদি নিম্ন আয়ের মানুষ হয়, তাহলে সে তো জ্বরটাকে পাত্তা দেবে না। কিন্তু যখন তা জটিল অবস্থায় যাবে তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও হয়ত বেশি কিছু করার সুযোগ থাকবে না। তাই প্রাথমিক অবস্থায় ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালু থাকতে হবে। পানি জমার পাত্র দূর করাকে সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এটা শুধু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও তার অন্তর্গত সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে সম্ভব না। তাদের মধ্যে কমিউনিটিভিত্তিক কাজের সুযোগ থাকতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় তরুণ-যুবকদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে হবে। তাদের সঙ্গে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। তারা রোগী খুঁজবে, রোগীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে। সেই বাড়ির আশেপাশে এডিস মশার প্রজননের মতো পরিবেশ আছে কিনা তা দেখবে। বাড়ির মানুষের সহায়তায় তারা তা পরিষ্কার করবে। তৃণমূল পর্যায়ে রোগী, মশা জন্মের পরিবেশ খোঁজা ও পরিষ্কার এবং রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনার মতো কাজগুলো করা যায় তাহলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাবে।
বিপরীতে এটি যদি না করে আমরা শুধু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা, বড় বড় হাসপাতালে বেড ও ওষুধ আছে কিনা তা নিয়ে কাজ করি তাহলে রোগী কমানো ও মৃত্যুরোধ করা যাবে না।
এ রকম ১০টা টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালের সাথে ২০টি প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র থাকতে হবে। গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে যা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র। এগুলোকে সজ্জিত করতে হবে। শহরে এমন কোনো স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নাই। এর জন্য ভ্রাম্যমাণ প্রথামিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র করতে পারে। একটি মাইক্রোবাসে করে স্বাস্থ্যকর্মীরা এলাকায়-এলাকায় গিয়ে যাদের জ্বর আছে তাদের নমুন সংগ্রহ করবে। এরপর এসএমএসের মাধ্যমে পরীক্ষার ফল জানিয়ে দেবে। এভাবে কাজ করতে পারলে আমরা পরিস্থিতি বদলাতে পারব।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। শুধু গণমাধ্যমে প্রচার না চালিয়ে সরকারকে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।